পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম @の〉 যেখানে বাধা পায় সেইখনেই তাহার বেদনা লাগে। সেইখনেই সে ক্রুদ্ধ হয়, লুব্ধ হয়, হনন করে, হরণ করে । কিন্তু আমাদের স্বাতন্ত্র্য তো অবাধে চলিতে পারে না । প্রথমত, সে যে-সকল মালমসলা যে-সকল ধনজন লইয়া আপনার কলেবর গড়িয়া তুলিতে চায়, তাহদেরও স্বাতন্ত্রা আছে ; আমাদের ইচ্ছামত কেবল গায়ের জোরে তাহাদিগকে নিজের কাজে লাগাইতে পারি না । তখন আমাদের স্বাতন্ত্রের সঙ্গে তাহাদের স্বাতন্ত্র্যের একটা বোঝাপড়া চলিতে থাকে । সেখানে বুদ্ধির সাহায্যে বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা একটা আপস করিয়া লই । সেখানে পরের স্বাতন্ত্র্যের খাতিরে নিজের স্বাতন্ত্রকে কিছু পরিমাণে খাটাে করিয়া না আনিলে একেবারে নিম্বফল হইতে হয় । তখন কেবলই স্বাতন্ত্রা মানিয়া নয়, নিয়ম কিন্তু এটা দায়ে পড়িয়া করা— ইহাতে সুখ নাই। একেবারে যে সুখ নাই, তাহা নহে। বাধাকে যথাসম্ভব নিজের প্রয়োজনের অনুগত করিয়া আনিতে যে বুদ্ধি ও যে শক্তি খাটে, তাহাতেই সুখ আছে । অর্থাৎ কেবল পাইবার সুখ নয়, খাটাইবার সুখ । ইহাতে নিজের স্বাতন্ত্রোর জোর স্বাতন্ত্রোর গৌরব অনুভব করা যায়— বাধা না পাইলে তাহা করা যাইত না | এইরূপে যে অহংকারের উত্তেজনা জন্মে, তাহাতে আমাদের জিতিবার ইচ্ছা, প্রতিযোগিতার চেষ্টা বাডিয়া উঠে । পাথরের বাধা পাইলে ঝরনার জল যেমন ফেনাইয়া ডিঙাইয়া উঠিতে চায়, তেমনি পরস্পরের বাধায় আমাদের পরস্পরের স্বাতন্ত্র্য ঠেলিয়া ফুলিয়া উঠে । যাই হোক, ইহা লড়াই ] বুদ্ধিতে বুদ্ধিতে শক্তিতে শক্তিতে চেষ্টায় চেষ্টায় লড়াই। প্রথমে এই লড়াই বেশির ভাগ গায়ের জোরই খাটাইত, ভাঙিয়া-চুরিয়া কাজ-উদ্ধারের চেষ্টা করিত । ইহাতে যাহাকে চাই, তাহাকেও ছারখার করা হইত ; যে চায়, সেও ছারখার হইত। অপবায়ের সীমা থাকিত না। তাহার পরে বুদ্ধি আসিয়া কর্মকৌশলের অবতারণা করিল। সে গ্রন্থি ছেদন করিতে চাহিল না, গ্ৰন্থি মোচন করিতে বসিল । এ কাজটা ইচ্ছার অন্ধতা বা অধৈর্যের দ্বারা হইবার জো নাই ; শান্ত হইয়া সংযত হইয়া শিক্ষিত হইয়া ইহাতে প্ৰবৃত্ত হইতে হয় । এখানে জিতিবার চেষ্টা নিজের সমস্ত অপব্যয় বন্ধ করিয়া নিজের বলকে গোপন কবিয়া বলী হইয়াছে । কারনা যেমন উপত্যকায় পড়িয়া কতকটা বেগসংবরণ করিয়া প্রশস্ত হইয়া উঠে, আমাদের স্বাতন্ত্রোর বেগ তেমনি বাহুবল ছাড়িয়া বিজ্ঞানে আসিয়া আপনার উগ্রতা ছাড়িয়া উদারতা লাভ করে । ইহা আপনিই হয় । জোর কেবল নিজেকেই জানে, অন্যকে মানিতে চায় না । কিন্তু বুদ্ধি কেবল নিজের স্বাতন্ত্রা লইয়া কাজ করিতে পারে না । অন্যের মধ্যে তাহাকে প্রবেশ করিয়া সন্ধান করিতে হয়— অন্যকে সে যতই বেশি করিয়া বুঝিতে পরিবে, ততই নিজের কাজ উদ্ধার করিতে পরিবে: অনাকে বুঝিতে গেলে, অনোর দরজায় ঢুকিতে গেলে নিজেকে অনোর নিয়মের অনুগত করিতেই হয় | এইরূপে স্বাতন্ত্র্যের চেষ্টা জয়ী হইতে গিয়াই নিজেকে পরাধীন না করিয়া থাকিতে পারে না । এ-পর্যন্ত কেবল প্রতিযোগিতার রণক্ষেত্রে আমাদের পরস্পরের স্বাতন্ত্র্যের জয়ী হইবার চেষ্টাই দেখা গৈল । ডারউয়িনের প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্ব এই রণভূমিতে লড়াইয়ের তত্ত্ব— এখানে কেহ কাহাকেও রেয়াত করে না, সকলেই সকলের চেয়ে বড়ো হইতে চায় । কিন্তু ক্রপট্টকিন প্রভৃতি আধুনিক বিজ্ঞানবিংরা দেখাইতেছেন যে পরস্পরকে জিতিবার চেষ্টা, নিজেকে টেকাইয়া রাখিবার চেষ্টাই প্ৰণিসমাজেৰ একমাত্র চেষ্টা নয় । দল বাধিবার, পরস্পরকে সাহায্য করিবার ইচ্ছা, ঠেলিয়া উঠিবার চেষ্টার চেয়ে অল্প প্রবল নহে ; বস্তুত নিজের বাসনাকে খর্ব করিয়াও পরস্পরকে সাহায্য করিবার ইচ্ছাই প্রাণীদের মধ্যে উন্নতির প্রধান উপায় হইয়াছে। তবেই দেখিতেছি এক দিকে প্রত্যেকের স্বাতন্ত্রোর স্মৃর্তি এবং অন্য দিকে সমগ্রের সহিত সামঞ্জস্য, এই দুই নীতিই একসঙ্গে কাজ করিতেছে। অহংকার এবং প্রেম, বিকর্ষণ এবং আকর্ষণ সৃষ্টিকে একসঙ্গে গড়িয়া তুলিতেছে। স্বাতন্ত্রেও পূর্ণতালাভ করিব এবং মিলনেও নিজেকে পূর্ণভাবে সমর্পণ করিব, ইহা হইলেই মানুষের