পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম ○○(? তবেই দেখা যাইতেছে, জগতের সম্বন্ধগুলিকে আমরা ধ্বংস করিতে পারি না, তাহদের ভিতর দিয়া গিয়া তাহাদিগকে উত্তীর্ণ হইতে পারি। অর্থাৎ সকল সম্বন্ধ যেখামে আসিয়া মিলিয়াছে, সেইখানে পৌঁছতে পারি। অতএব, ঠিকভাবে এই ভিতর দিয়া যাওয়াটাই সাধনী— কোনো সম্বন্ধকে নাই বলিয়া বিমুখ হওয়াই সাধনা নহে। পথকে যদি বৈরাগের জোরে ছাড়িয়া দাও, অপথে। তবে সাতগুণ বেশি ঘুর খাইয়া মরিতে হইবে । জর্মান মহাকবি গায়টে তাহার ফাউস্ট নাটকে দেখাইয়াছেন যে-ব্যক্তি মানব প্রবৃত্তিকে উপবাসী রাখিয়া সংসারের লীলাভূমি হইতে উচ্চে নিভৃতে বসিয়া জ্ঞানসংগ্ৰহ করিতে প্ৰবৃত্ত ছিল, সংসারের ধূলার উপরে বহুজোরে আছড়ে খাইয়া তাহাকে কেমনতরো শক্ত জ্ঞান লাভ করিতে হইয়াছিল । মুক্তির প্রতি অসময়ে অযথা লোভ করিয়া যেটুকু ফাকি দিতে যাইব, সেটুকু তো শোধ করিতেই হইবে, তাহার উপরে আবার ফকির চেষ্টার জন্য দণ্ড আছে । বেশি তাড়াতাড়ি করিতে গেলেই বেশি বিলম্ব ঘটিয়া श2 | বস্তুত গ্রহণ এবং বর্জন, বন্ধন এবং বৈরাগ্য, এই দুটাই সমান সত্য-- একের মধ্যেই অন্যটির বাসা, কেহ কহাকেও ছাড়িয়া সত্য নহে । দুইকে যথার্থরূপে মিলাইতে পারিলেই তবে পূর্ণতা লাভ করিতে পারা যায়। শংকর ত্যাগের এবং অন্নপূর্ণ ভোগের মূর্তি— উভয়ে মিলিয়া যখন একাঙ্গ হইয়া যায়, তখনই সম্পূর্ণতার আনন্দ । আমাদের জীবনে যেখানেই এই শিব ও শিবানীর বিচ্ছেদ, যেখানেই বন্ধন ও মুক্তির একত্রে প্রতিষ্ঠা নাই, যেখানেই অনুরাগ ও বৈরাগ্যের বিরোধ ঘটিয়াছে সেইখানেই যত অশান্তি, যত নিরানন্দ । সেইখানেই আমরা লইতে চাই, দিতে চাই না ; সেইখানেই আমরা নিজের দিকে টানি, অন্যের দিকে তাকাই না ; সেইখানেই আমরা যাহাকে ভোগ করি, তাহার। আর অন্ত দেখিতে পাই না- অন্ত দেখিলে বিধাতাকে ধিক্কার দিয়া হাহাকার করিতে থাকি ; সেখানেই কর্মে আমাদের প্রতিযোগিতা, ধর্মেও আমাদের বিদ্বেষ, ; সেখানেই কোনো-কিছুরই যেন স্বাভাবিক পরিণাম নাই, অপঘাতমুতুতেই সমস্ত ব্যাপারের অকস্মাৎ বিলোণ । জীবনটাকে না-হয় যুদ্ধ বলিয়াই গণ্য করা গেল। এই যুদ্ধ ব্যাপারে যদি কেবল বৃহের মধ্যে প্রবেশ করিবার বিদ্যা আমাদের শেখা থাকে, বৃহ হইতে বাহির হইবার কৌশল আমরা না জানি, তবে সপ্তরিখী ঘিরিয়া যে আমাদিগকে মারিবে । সেরূপ মরিয়াও আমরা বীরত্ব দেখাইতে পারি, কিন্তু যুদ্ধে জয় তো তাহাকে বলে না । অপর পক্ষে, যাহারা বৃহের মধ্যে একেবারে প্রবেশ করিতেই বিরত, সেই কাপুরুষদের বীরের সদগতি নাই | প্রবেশ করা এবং বাহির হওয়া, এই দুয়ের দ্বারাতেই জীবনের চরিতার্থতা । প্রাচীন সংহিতাকারগণ হিন্দুসমাজে হরগৌরীকে অভেদাঙ্গ করিতে চাহিয়াছিলেন— বিশ্বচরাচর যে গ্রহণ ও বর্জন, যে আকর্ষণ ও বিপ্রকর্ষণ, যে কেন্দ্ৰানুগ ও কেন্দ্রাতিগ, যে স্ত্রী ও পুরুষ ভাবের নিয়ত সামঞ্জস্যের উপর প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া সত্য ও সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে, সমাজকে তাহারা প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সকল দিকে সেই বৃহৎ সামঞ্জস্যের উপরে স্থাপিত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন । শিব ও শক্তির, নিবৃত্তি ও প্রবৃত্তির সম্মিলনই সমাজের একমাত্র মঙ্গল, এবং শিব ও শক্তির বিরোধই সমাজের সমস্ত অমঙ্গলের কারণ, ইহাই তাহারা বুঝিয়াছিলেন । এই সামঞ্জস্যকে আশ্রয় করিতে হইলে প্রথমে মানুষকে সভ্যভাবে দেখিতে হইবে । অর্থাৎ তাহাকে কোনো একটা বিশেষ প্রয়োজনের দিক হইতে দেখিলে চলিবে না । আমরা যদি আম্রকে অম্বল খাওয়ার দিক হইতে দেখি, তাহা হইলে তাহাকে সমগ্রভাবে দেখি না ; এইজন্য তাহার স্বাভাবিক পরিণামে বাধা ঘটাই ; তাহাকে কঁচা পাড়িয়া আনিয়া তাহার কষিটাকে মাটি করিয়া দিই ! গাছকে যদি জ্বালানি কাঠ বুলিয়াই দেখি, তবে তাহার ফলফুলপাতার কোনো তাৎপৰ্যই দেখিতে পাই না । তেমনি জাতীয়সমৃদ্ধিবৃদ্ধির হেতু বলিয়া গণ্য করি, তবে তাহাকে বণিক করিবার একান্ত চেষ্টা করিব- এমনি করিয়া আমাদের আবহমান সংস্কার অনুসারে যেটাকেই আমরা পৃথিবীতে সকলের চেয়ে অভিলষিত