পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(? > S রবীন্দ্র-রচনাবলী হইয়া উঠিয়াছে। বিশ্বশক্তির সঙ্গে প্রাণশক্তির সুর অনেকদিন হইতে বাধিয়া চুকিয়া গেছে, সেজন্য বড়ো ভাবিতে হয় না ; কিন্তু ইচ্ছাশক্তির সুরবাধা লইয়া আমাদিগকে অহরহ ঝঞািট পোহাইতে হয়। খাদ্যসম্বন্ধে প্ৰাণশক্তির আবশ্যক হয়তো ফুরাইল, কিন্তু আমাদের ইচ্ছার তাগিদ শেষ হইল নাশরীরের আবশ্যক সাধনে সে যে আনন্দ পাইল, সেই আনন্দকে সে আবশ্যকের বাহিরেও টানিয়া লইয়া যাইতে চেষ্টা করিল— সে নানা কৃত্রিম উপায়ে বিমুখ রসনাকে রসসিক্ত করিতে ও শ্রান্ত পাকযন্ত্রকে উত্তেজিত করিতে লাগিল, এমনি করিয়া বাহিরের সহিত প্ৰাণের এবং প্রাণের সহিত মনের একতনতা নষ্ট করিয়া সে নানা অনাবশ্যক চেষ্টা, অনাবশ্যক উপকরণ ও শাখাপল্লবায়িত দুঃখের সৃষ্টি করিয়া চলিল। আমাদের যাহা প্রয়োজন, তাহার সংগ্রহই যথেষ্ট দুরূহ, তাহার উপরে ভূরিপরিমাণ অনাবশ্যকের বোঝা চাপিয়া সেই আবশ্যকের আয়োজনও কষ্টকর হইয়া উঠিয়াছে। শুধু তাঁহাই নয়— ইচ্ছা যখন একবার স্বভাবের সীমা লঙঘন করে, তখন কোথাও তাহার আর থামিবার কারণ থাকে না, তখন সে “হাবিষ, কৃষ্ণবর্ক্সেব ভুয় এবাভিবর্ধতে”— কেবল সে চাই চাই করিয়া বাড়িয়াই চলে । পৃথিবীতে নিজের এবং পরের পনেরো-আনা দুঃখের কারণ ইহাই । অথচ এই ইচ্ছা-শক্তিকেই বিশ্বশক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য আনাই আমাদের পরমানন্দের হেতু | এইজন্য ইচ্ছাকে নষ্ট করা আমাদের সাধনার বিষয় নহে, ইচ্ছাকে বিশ্ব-ইচ্ছার সঙ্গে এক সুরে বাধাই আমাদের সকল শিক্ষার চরম লক্ষ্য । গোড়ায় তাহা যদি না করি, তবে আমাদের চঞ্চল মনে জ্ঞান লক্ষ্যভ্রষ্ট, প্ৰেম কলুষিত ও কর্ম বৃথা পরিভ্রান্ত হইতে থাকে | জ্ঞান, প্রেম ও কর্ম বিশ্বের সহিত সহজ মিলনে মিলিত না হইয়া আমাদের আত্মম্ভরি ইচ্ছার কৃত্ৰিম সৃষ্টি-সকলের মধ্যে মরীচিকা-অনুসরণে নিযুক্ত হইতে থাকে । এইজন্য আমাদের আয়ুর প্রথম ভাগে ব্ৰহ্মচর্যপালন দ্বারা ইচ্ছাকে তাহার যথাবিহিত সীমার মধ্যে সহজে সঞ্চরণ করিবার অভ্যাস করাইতে হইবে । ইহাতে আমাদের বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানসপ্রকৃতির সুর বাধা হইয়া আসিবে । তাহার পরে সেই সুরে তোমার সাধ্যমত ও ইচ্ছামত যে-কোনো রাগিণী বাজাও-না কেন, সত্যের সুরকে মঙ্গলের সুরকে আনন্দের সুরকে আঘাত করিবে না । এইরূপে শিক্ষার কাল যাপন করিয়া সংসারধর্মে প্ৰবৃত্ত হইতে হইবে । মনু বলিয়াছেন— ። ন তথৈতানি শক্যান্তে সংনিয়ন্তমসেবয়া | বিষয়েষ্ণু প্রজুষ্টানি যথা জ্ঞানেন নিত্যশ: | বিষয়ের সেবা না করিয়া সেরূপ সংযমন করা যায় না, বিষয়ে নিযুক্ত থাকিয়া জ্ঞানের দ্বারা নিত্যাশ যেমন করিয়া করা যায় । অর্থাৎ বিষয়ে নিযুক্ত না হইলে জ্ঞান পূর্ণতালাভ করে না, এবং যে সংযম জ্ঞানের দ্বারা লব্ধ নহে, তাহা পূৰ্ণসংযম নহে— তাহা জড় অভ্যাস বা অনভিজ্ঞতার অন্তরালমাত্ৰ— তাহা প্রকৃতির মূলগত নহে, তাহা বাহ্যিক । ংযমের সঙ্গে প্রবৃত্তিকে চালনা করিবার শিক্ষা ও সাধনা থাকিলেই কর্ম, বিশেষত মঙ্গলকর্ম করা সহজ ও সুখসাধ্য হয় | সেই অবস্থাতেই গৃহাশ্রম জগতের কল্যাণের আধার হইয়া উঠে। সেই অবস্থাতেই গৃহাশ্রম মানুষের মুক্তিপথে অগ্রসর হইবার বাধা নহে, সহায় হয়। সেই অবস্থাতেই গৃহস্থ যে-কোনাে কর্ম করেন, তাহা সহজে ব্ৰহ্মকে সমর্পণ করিয়া আনন্দিত হইতে পারেন। গৃহের সমস্ত কর্ম যখন মঙ্গলকর্ম হয়— তাহা যখন ধর্মকর্ম হইয়া উঠে, তখন, সেই কর্মের বন্ধন মানুষকে বাধিয়া একেবারে জর্জৱীভূত করিয়া দেয় না । যথাসময়ে সে-বন্ধন অনায়াসে স্থলিত হইয়া যায়, যথাসময়ে সে-কর্মের একটা স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি আপনি আসে। আয়ুর দ্বিতীয় ভাগকে এইরূপে সংসারধর্মে নিযুক্ত করিয়া শরীরের তেজ যখন হ্রাস হইতে থাকিবে, তখন এ কথা মনে রাখিতে হইবে যে, এই ক্ষেত্রের কাজ শেষ হইল- সেই খবরটা আসিল । শেষ হইল খবর পাইয়া চাকরি-বরখাস্ত হতভাগার মতো নিজেকে দীন বলিয়া দেখিতে হইবে না । আমার সমস্ত গেল, ইহাকেই অনুশোচনার বিষয় করিলে চলিবে না, এখন আরো বড়ো পরিধিবিশিষ্ট ক্ষেত্রের