পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম Ꮹ ᎩᏔᏬ মধ্যে প্রবেশ করিতে হইবে বলিয়া সেই দিকে আশার সহিত বলের সহিত মুখ ফিরাইতে হইবে। যাহা কহিল— সেখানে যাহা-কিছু ফসল জন্মাইয়াছি, তাহা কাটিয়া মাড়াই করিয়া গোলা বােঝাই করিয়া দিয়া এ মজুরি শেষ করিয়া চলিলাম— এবার সন্ধ্যা আসিতেছে- আপিসের কুঠরি ছাড়িয়া বড়ো রাস্ত ধরিতে হইবে। ঘরে না পৌঁছিলে তো চরমশান্তি নাই। যেখানে যতী-কিছু সহিলাম, কত-কিছু খাটিলাম, সে কিসের জন্য ? ঘরের জন্য তো ? সেই ঘরই ভূমি— সেই ঘরই আনন্দ— যে আনন্দ হইতে আমরা আসিয়াছি, যে আনন্দে আমরা যাইব । তাহা যদি না হয়, তবে ততঃ কিম, ততঃ কিম, ততঃ কিম | তাই গৃহাশ্রমের কােজ সারিয়া সন্তানের হাতে সংসারের ভর সমর্পণ করিয়া এবার বড়ো রাস্তায় বাহির হইবার সময় ৷ এবার বাহিরের খোলা বাতাসে বুক ভরিয়া লইতে হইবে— খোলা আকাশের আলোতে দৃষ্টিকে নিমগ্ন এবং শরীরের সমস্ত রোমকপকে পুলকিত করিতে হইবে । এবার একদিককার পালা সমাধা হইল । আঁতুড়ঘরে নাউী কাটা পড়িল, এখন অন্য জগতে স্বাধীন সঞ্চরণের অধিকার লাভ শিশু গৰ্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইলেও সম্পূর্ণ স্বাধীন হইবার পর্বে কিছুকাল মাতার কাছেকাছেই থাকে । বিযুক্ত হইয়াও যুক্ত থাকে, সম্পূর্ণ বিযুক্ত হইবার জন্য প্রস্তুত হয় । বানপ্ৰস্থ-আশ্রিমও সেইরূপ । সংসারের গর্ভ হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়াও বাহিরের দিক হইতে সংসারের সঙ্গে সেই তৃতীয়-আশ্রমধারীর যোগ থাকে । বাহিরের দিক হইতে সে সংসারকে আপনার জীবনের সঞ্চিত জ্ঞানের ফলদান করে এবং সংসার হইতে সহায়তা গ্রহণ করে । এই দান-গ্ৰহণ সংসারীর মতো একান্তভাবে করে না, মুক্তভাবে করে । অবশেষে আয়ুর চতুর্থভাগে এমন দিন আসে, যখন এই বন্ধনটুকুও ফেলিয়া একাকী সেই পরম একের সম্মুখীন হইতে হয় । মঙ্গলকার্মের দ্বারা পৃথিবীর সমস্ত সম্বন্ধকে পূর্ণপরিণতি দান করিয়া আনন্দস্বরূপের সহিত চিরন্তন সম্বন্ধকে লাভ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে হয় । পতিব্ৰতা স্ত্রী যেমন সমস্তদিন সংসারের নানা লোকের সহিত নানা সম্বন্ধ পালন করিয়া নানা কম সমাধা করিয়া স্বামীরই কর্ম করেন, স্বামীরই সম্বন্ধ যথার্থভাবে স্বীকাব করেন ; অবশেষে দিন-অবসান হইলে একে একে কাজের জিনিসগুলি তুলিয়া রাখিয়া, কাজের কাপড় ছাড়িয়া, গা ধুইয়া, কর্মস্থানের চিহ্ন মুছিয়া নির্মল মিলনবেশে একাকিনী স্বামীর সহিত একমাত্র পূর্ণসম্বন্ধের অধিকার গ্রহণ করিবার জন্য নির্জনগৃহে প্রবেশ করেন, সমাপ্তকৰ্ম পুরুষ সেইরূপ একে একে কাজের জীবনের সমস্ত খণ্ডতা ঘুচাইয়া দিয়া অসীমের সহিত সম্মিলনের জন্য প্রস্তুত হইয়া অবশেষে একাকী সেই একের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হন এবং সম্পূর্ণ জীবনকে এই পরিপূর্ণ সমাপ্তির মধ্যে অখণ্ড সার্থকতা দান করেন। এইরূপেই মানবজীবন আদ্যোপােন্ত সত্য হয়, জীবন মৃত্যুকে লঙঘন করিতে বৃথা চেষ্টা করে না ও মৃত্যু শত্রুপক্ষের ন্যায় জীবনকে আক্রমণ করিয়া বলপূর্বক পরাস্ত করে না। জীবনকে আর আমরা যেমন করিয়াই খণ্ডবিখণ্ড বিক্ষিপ্ত করি, অন্য যে-কোনো অভিপ্ৰায়কেই আমরা চরম বলিয়া জ্ঞান করি এবং তাঁহাকে আমরা দেশ-উদ্ধার, লোকহিত বা যে-কোনো বড়ো নাম দিই-না কেন, তাহার মধ্যে সম্পূর্ণতা থাকে না— তাহা আমাদিগকে মাঝপথে অকস্মাৎ পরিত্যাগ করে, তাহার মধ্য হইতে এই প্রশ্নই কেবলই বাজিতে থাকে— ততঃ কিম, ততঃ কিম, ততঃ কিম। আর ভারতবর্ষ চারি আশ্রমের মধ্য দিয়া মানুষের জীবনকে বাল্য, যৌবন, প্রৌঢ়বয়স ও বার্ধক্যের স্বাভাবিক বিভাগের অনুগত করিয়া অধ্যায়ে অধ্যায়ে যেরূপ একমাত্র সমাপ্তির দিকে লইয়া গিয়াছেন, তাহাতে বিশাল বিশ্বসংগীতের সহিত মানুষের জীবন অবিরোধে সম্মিলিত হয়। বিদ্রোহ-বিরোধ থাকে না ; অশিক্ষিত প্রবৃত্তি আপনার উপযুক্ত স্থানকাল বিস্মৃত হইয়া যে-সকল গুরুতর অশান্তির সৃষ্টি করিতে থাকে, তাহারই মধ্যে বিভ্রান্ত ও নিখিলের সহিত সহজ-সত্যসম্বন্ধ-ভ্ৰষ্ট হইয়া পৃথিবীর মধ্যে উৎপাত স্বরূপ হইয়া উঠিতে হয় না । আমি জানি, এইখানে একটা প্রশ্ন উদয় হইবে যে, একটা দেশের সকল লোককেই কি এই আদর্শে