পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

محے KAN (SC আমরা সকলের চেয়ে বড়ো সুর যাহা শুনিয়াছি, এ সুর যে তাহাকে আঘাত করিতেছে- আমাদের অন্তরাত্মা এক জায়গায় ইহাকে কেবলই অস্বীকার করিতেছে। আমরা কোনোদিন এমনতরো হাটের মানুষ ছিলাম না। আজ আমরা হাটের মধ্যে বাহির হইয়া ঠেলাঠেলি ও চীৎকার করিতেছি- ইতর হইয়া উঠিয়াছি, কলহে মাতিয়াছি, পদ ও পদবী লইয়া কড়াকড়ি করিতেছি, বড়ো অক্ষরের ও উচ্চকণ্ঠের বিজ্ঞাপনের দ্বারা নিজেকে আর-পাঁচজনের চেয়ে অগ্রসর করিয়া ঘোষণা করিবার প্রাণপণ চেষ্টা চলিতেছে । অথচ ইহা একটা নকল । ইহার মধ্যে সত্য অতি অল্পই আছে। ইহার মধ্যে শান্তি নাই, গান্তীর্য নাই, শিষ্টতাশীলতার সংযম নাই, শ্ৰী নাই। এই নকলের যুগ আসিবার পর্বে আমাদের মধ্যে এমন একটা স্বাভাবিক মর্যাদা ছিল যে, দারিদ্রোও আমাদিগকে মানাইত, মোটা ভাত মোটা কাপড়ে আমাদের গৌরব নষ্ট করিতে পারিত না । কৰ্ণ যেমন তাহার কবচকুণ্ডল লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তখনকার দিনে আমরা সেইরূপ একটা স্বাভাবিক আভিজাতের কবচ লইয়াই জন্মিাতাম ! সেই কবচেই আমাদিগকে বহুদিনের অধীনতা ও দুঃখদারিদ্র্যের মধ্যেও বাচাইয়া রাখিয়াছে- আমাদের সম্মান নষ্ট করিতে পারে নাই । কারণ, আমাদের সে সম্মান বাহিরের আহরণ-করা ধন ছিল না, সে আমাদের অন্তরের সামগ্ৰী ছিল । সেই সহজাত কবচখানি আমাদের কােছ হইতে কে ভুলইয়া লইল । ইহাতেই আমাদের আত্মরক্ষার উপায় চলিয়া গেছে। এখন আমরা বিশ্বের মধ্যে লজিত ! এখন আমাদের বেশে-ভূষায় আয়োজনে উপকরণে একটু কোথাও কিছু খাটাে পড়িয়া গেলেই আমরা আর মাথা তুলিতে পারি না । সম্মান এখন বাহিরের জিনিস হইয়া পড়িয়ছে, তাই উপাধির জন্য খ্যাতির জন্য আমরা বাহিরের দিকে ছুটিয়াছি, বাহিরের আড়ম্বরকে কেবলই বাড়াইয়া তুলিতেছি, এবং কোথাও একটু-কিছু ছিদ্র বাহির হইবার উপক্ৰম হইলেই তাহাকে মিথ্যার তালি দিয়া ঢাকা দিবার চেষ্টা করিতেছি । কিন্তু ইহার অন্ত কোথায় y যে ভদ্রতা আমাদের অন্তরের সামগ্ৰী ছিল, তাহাকে আজ যদি বাহিরে টানিয়া জুতার দোকান, কাপড়ের দোকান, ঘোড়ার হাট এবং গাড়ির কারখানায় ঘোরাইতে আরম্ভ করি, তবে কোথায় লইয়া গিয়া তাহাকে বলিব, ব্যস, হইয়াছে, এখন বিশ্রাম করে । আমরা সন্তোষকেই সখের পূর্ণতা বলিয়া জনিতাম ; কারণ, সন্তোষ অন্তরের সামগ্ৰী— এখন সেই সুখকে যদি হাটে-হাটে ঘাটে-ঘাটে খুজিয়া ফিরিতে হয়, তবে কবে বলিতে পারিবী, সুখ পাইয়াছি । এখন আমাদের ভদ্রতাকে সস্তী কাপড়ে অপমান করে, বিলাতি গৃহসজ্জার অভাবে উপহাস করে, চেকবহির অঙ্কপাতের ন্যানতায় তাহার প্রতি কলঙ্কপাত করে---- এমন ভদ্রতাকে মজুরের মতো বহন করিয়া গৌরববোধ করা যে কত লজ্জাকর, তাহাঁই আমরা ভুলিতে বসিয়াছি। আর যে-সকল পরিণামহীন উত্তেজনা উন্মাদনাকে আমরা সুখ বলিয়া বরণ করিয়া লইয়াছি, তাহার দ্বারা আমাদের মতো বহির্বিষয়ে পরাধীন জাতিকে অন্ত:করণেও দাসানদাস করিয়াছে | কিন্তু তবু বলিতেছি, এই উপসর্গ এখনো আমাদের মজার মধ্যে প্রবেশ করে নাই ৷ এখনো ইহা বাহিরেই পড়িয়া আছে ; এবং বাহিরে আছে বলিয়াই ইহার কলরব এত বেশি -- সেইজন্যই ইহার এত আতিশয্য ও অতিশয়োক্তির প্রয়োজন হয় ৷ এখনো এ আমাদের গভীরতর স্বভাবের অনুগত হয় নাই বলিয়াই সন্তরণ-মূঢ়ের সাতারকাটার মতো ইহাকে লইয়া আমাদিগকে এমন উন্মত্তের ন্যায় আস্ফালন করিতে হয় । কিন্তু একবার কেহ যদি আমাদের মধ্যে দাড়াইয়া যথার্থ অধিকারের সহিত এ কথা বলেন যে, "অসম্পূর্ণ প্রয়াসে, উন্মত্ত প্রতিযোগিতায়, অনিত্য ঐশ্বর্ষে আমাদের শ্রেয় নহে- জীবনের একটি পরিপূর্ণ পরিণাম আছে, সকল কর্ম সকল সাধনার একটি পরিপূর্ণ পরিসমাপ্তি আছে, এবং সেই পরিণাম সেই পরিসমাপ্তিই আমাদের প্রত্যেকের একমাত্র চরম চরিতার্থতা— তাহার নিকটে আর সমস্তই তুচ্ছ”— তবে আজও এই হাট-বাজারের কোলাহলের মধ্যেও আমাদের সমস্ত হৃদয় সায় দিয়া উঠে, বলে, “সত্য, ইহাই সত্য, ইহার চেয়ে সত্য আর কিছুই নাই ।” তখন, ইস্কুলে যে-সকল ইতিহাসের পড়া মুখস্থ করিয়াছিলাম ; কাড়াকড়ি-মািরামারির কথা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিমানকেই সর্বোচ্চ সিংহাসনে নররক্ত দিয়া অভিষেক করিবার কথা অত্যন্ত ক্ষীণ-খর্ব হইয়া আসে ; তখন লালকুর্তিপরা