পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ζ Σν রবীন্দ্র-রচনাবলী জাগাইয়া তোলে— তবেই আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি, আনন্দরূপে অমৃতরূপে যিনি চতুর্দিকেই প্রকাশ পাইতেছেন, সেই আনন্দময়ের উপাসনা সম্পূর্ণ হইবে । কোনো ভয় কোনো সংশয় কোনো দীনতা মনের মধ্যে রাখিয়ো না ; আনন্দে প্ৰভাতে জাগ্রত হও, আনন্দে দিনের কর্ম করো, দিব্যাবসানে নিঃশব্দ স্নিগ্ধ অন্ধকারের মধ্যে আনন্দে আত্মসমপণ করিয়া দাও, কোথাও যাইতে হইবে না, কোথাও। খুঁজতে হইবে না, সর্বত্র যে আনন্দরূপে তিনি বিরাজ করিতেছেন, সেই আনন্দরূপের মধ্যে তুমি আনন্দ লাভ করিতে শিক্ষা করো— যাহা-কিছু তোমার সম্মুখে উপস্থিত, পূর্ণ আনন্দের সহিত তাহাকে স্বীকার করিয়া লইবার সাধনা করো।-- সম্পদে সংকটে থাকো কল্যাণে থাকো আনন্দে নিন্দ অপমানে । সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে চির-অমৃত-নিঝরে শান্তিরসপনে । নিজের এই ক্ষুদ্র চােখের দীপ্তিটুকু যদি আমরা নষ্ট করিয়া ফেলি, তবে আকাশভরা আলো তো আর দেখিতে পাই না ; তেমনি আমাদের ছোটো মনের ছোটো ছোটাে বিষাদ-অবসাদ-নৈরাশ্য-নিরানন্দ আমাদিগকে অন্ধ করিয়া দেয়— আনন্দরূপমমৃতং আমরা আর দেখিতে পাই না- নিজের কালিমাদ্বারা আমরা একেবারে পরিবেষ্টিত হইয়া থাকি, চারি দিকে কেবল ভাঙাচোরা কেবল অসম্পূর্ণতা কেবল অভাব দেখি- কানা যেমন মধ্যাহ্নের আলোকে কালো দেখে, আমাদেরও সেই দশা ঘটে । একবার চোখ যদি খোলে, যদি দৃষ্টি পাই, হৃদয়ের মধ্যে নিমেষের মধ্যেও যদি সেই আনন্দ সপ্তকে সপ্তকে বাজিয়া উঠে, যে-আনন্দে জগদব্যাপী আনন্দের সমস্ত সুর মিলিয়া যায়, তবে যেখানেই চোখ পড়ে সেখানে তাহাকেই দেখি- আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি । বধে-বন্ধনে দুঃখে-দারিদ্রো অপকারে-অপমানেও তীহাকেই দেখি— আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি । তখন মুহুর্তেই বুঝিতে পারি, প্রকাশমাত্রই তাঁহারই প্রকাশ- এবং প্রকাশমাত্ৰই আনন্দ রূপমমৃতং । তখন বুঝিতে পারি, যে আনন্দে আকাশে-আকাশে আলোক উদ্ভাসিত, আমাতেও সেই পরিপূর্ণ আনন্দেরই প্রকাশ- সেই আনন্দে আমি কাহারও চেয়ে কিছুমাত্র নূ্যন নহি, আমি সকলেরই সমান, আমি জগতের সঙ্গে এক | সেই আনন্দে আমার ভয় নাই ক্ষতি নাই অসম্মান নাই ; আমি আছি, কারণ আমাতে পরিপূর্ণ আনন্দ আছেন, কে তাহার কণামাত্রও অপলাপ করিতে পারে ? এমন কী ঘটনা ঘটিতে পারে, যাহাতে তাহার লেশমাত্র ক্ষুন্নতা হইবে ? তাই আজি আনন্দের দিনে, আজ উৎসবের প্রভাতে আমরা যেন সমস্ত অস্তরের সহিত বলিতে পারি।-- এষাস্য পরম গতিঃ এযাস্য পরম সম্পৎ, এযোহস্য পরমে লোক এষোহস্য পরম আনন্দঃ- এবং প্রার্থনা করি, যেন সেই আনন্দের এমন একটু অংশ লাভ করিতে পারি, যাহাতে সমস্ত জীবনের প্রত্যেক দিনে সর্বত্র তাহাকেই স্বীকার করি, ভয়কে নয়, দ্বিধাকে নয়, শোককে নয়— তাহাকেই স্বীকার করি— আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি । তিনি প্রচুর রূপে আপনাকে দান করিতেছেন, আমরা প্রচুররাপে গ্রহণ করিতে পারিব না কেন ? তিনি প্রচুর ঐশ্বর্যে এই যে দিগদিগন্ত পূৰ্ণ করিয়া রহিয়াছেন, আমরা সংকুচিত হইয়া দীন হইয়া অতি ক্ষুদ্র আকাঙক্ষা লইয়া সেই অবারিত ঐশ্বর্যের অধিকার হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিব কেন ? হাত বাড়াও । বক্ষকে বিস্তুত করিয়া দাও । দুই হাত ভরিয়া চোখ ভরিয়া প্ৰাণ ভরিয়া অবাধ আনন্দে সমস্ত গ্রহণ করো। তাহার প্রসন্নদৃষ্টি যে সর্বত্র হইতেই তোমাকে দেখিতেছে- তুমি একবার তোমার দুই চোখের সমস্ত জড়তা সমস্ত বিষাদ মুছিয়া ফেলো— তােমার দুই চক্ষুকে প্রসন্ন করিয়া চাহিয়া দেখাে, তখনই দেখিবে, তাহারই প্ৰসন্নসুন্দর কল্যাণমুখ তোমাকে অনন্তকাল রক্ষা করিতেছে— সে কী প্রকাশ, সে কী সৌন্দর্য, সে কী প্ৰেম, সে কী আনন্দ রূপমমৃতং ! যেখানে দানের লেশমাত্ৰ কৃপণতা নাই সেখানে গ্রহণে এমন কৃপণতা কেন ? ওরে মূঢ়, ওরে অবিশ্বাসী, তোর সম্মুখেই সেই আনন্দমুখের দিকে তাকাইয়া সমস্ত প্ৰাণমনকে প্রসারিত করিয়া পাতিয়া ধর— বলের সহিত বল— ‘অল্প নহে, আমার সবই চাই। ভূমৈব সুখং নান্সে সুখমস্তি । তুমি যতটা দিতেছ, আমি সমস্তটাই লইব । আমি ছোটােটার জন্য বড়োটাকে বাদ দিব না,