পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@Q8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সঙ্গে আমাদের মতে না মেলে তাদেরই আমরা পাষণ্ড বলি, নাস্তিক বলি, সংশয়াত্মা বলি। এই নিয়ে সংসারে কত দলাদলি কত বিবাদ বিরোধ কত শাসন পীড়ন তার আর অন্ত নেই। আমাদের দল এবং আমাদের দলের বাহির, এই দুইভাগে মানুষকে বিভক্ত করে আমরা ঈশ্বরের অধিকারকে নিজের দলের বিশেষ সম্পত্তি বলে গণ্য করে আরামে বসে আছি। এ সম্বন্ধে কোনো চিন্তা নেই সন্দেহ নেই। এই বলে কেবল কথাটুকুর মধ্যে ঈশ্বরকে স্বীকার করে আমরা সমস্ত সংসার থেকে তীকে নির্বাসিত করে দেখছি। আমরা এমন ভাবে গৃহে এবং সমাজে বাস করছি যেন সে গৃহে সে সমাজে ঈশ্বর নেই। আমরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই বিশ্বজগতের ভিতর দিয়ে এমন ভাবে চলে যাই যেন এ জগতে সেই বিশ্বভুবনেশ্বরের কোনো স্থান নেই। আমরা সকালবেলায় আশ্চর্য আলোকের অভ্যুদয়ের মধ্যে জাগ্রত হয়ে সেই অদ্ভুত আবির্ভাবের মধ্যে তীকে দেখতে পাই নে, এবং রাত্রিকালে যখন অনিমেষজাগ্রত নিঃশব্দ জ্যোতিষ্কলোকের মাঝখানে আমরা নিদ্রার গভীরতার মধ্যে প্রবেশ করতে যাই তখন এই আশ্চর্য শয়নাগারের বিপুলমহিমান্বিত অন্ধকার শয্যাতলের কোনো এক প্রান্তেও সেই বিশ্বজননীর নিস্তব্ধগভীর স্নিগ্ধমূর্তি অনুভব করি নে। এই অনির্বচনীয় অদ্ভুত জগৎকে আমরা নিজের জমিজমা ঘরবাড়ির মধ্যেই সংকীর্ণ করে দেখতে সংকোচবোধ করি নে। আমরা যেন ঈশ্বরের জগতে জন্মাই নি— নিজের ঘরেই জন্মেছি- এখানে আমি আমি আমি ছাড়া আর কোনো কথাই নেই– তবু আমরা বলি আমরা ঈশ্বরকে মানি, তার সম্বন্ধে আমার মধ্যে কোনো সংশয় নেই। আমার গৃহের মধ্যে সংসারের মধ্যে আমরা কোনোদিন এমন করে চলি নে যাতে প্রকাশ পায় যে এই গৃহের গৃহদেবতা তিনি, এই সংসার-রথকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেই মহাসারথি । আমিই ঘরের কর্তা, আমিই সংসারের সংসারী। ভোরের বেলা ঘুম ভাঙবামাত্রই সেই চিন্তাই শুরু হয় এবং রাত্রে ঘুম এসে সেই চিন্তাকেই ক্ষণকালের জন্য আবৃত করে । “আমি”র দ্বারাই এই গৃহ এই সংসার ঠাসা রয়েছে- কত দলিল, কত দস্তাবেজ, কত বিলিব্যবস্থা, কত বাদবিসংবাদ ! কিন্তু ঈশ্বর কোথায় ? কেবল মুখের কথায় ! আর কোথাও যে তিলধারণের স্থান নেই। এই মুখের কথায় ঈশ্বরকে স্বীকার করার মতো নিজেকে ফাকি দেবার আর কি কিছু আছে ? আমি এই সম্প্রদায়ভুক্ত, আমাদের এই মত, আমি এই কথা বলি— ঈশ্বরকে এইটুকুমাত্র ফকির জায়গা ছেড়ে দিয়ে তার পরে বাকি সমস্ত জায়গাটা অসংকোচে নিজে জুড়ে বসবার যে স্পর্ধা, সেই স্পর্ধা আপনাকে আপনি জানে না বলেই এত ভয়ানক । এই স্পর্ধা সংশয়ের সমস্ত বেদনাকে নিঃসাড় করে রাখে । আমরা যে জানি নে, এটাও জানতে দেয় না । সংশয়ের বেদনা তখনই জেগে ওঠে যখন গোপনভাবে ঈশ্বর আমাদের চৈতন্যের একটা দিকে স্পর্শ করেন । তখন সংসারের মধ্যে থেকেও সংসার আমাদের কান্না থামাতে পারে না । এবং তীর দিকে দুই বাহু প্রসারিত করেও অন্ধকারে তার নাগাল পাই নে। তখন এইটে জানা আরম্ভ হয় যে, যা পেয়েছি তাতে কোনোমতেই আমার চলবে না এবং যা না হলে আমার চলা অসম্ভব তা আমি কিছুতেই পাচ্ছি নে। এমন অসহ্য কষ্টের অবস্থা আর কিছুই নেই। যখন প্রসবের সময় আসন্ন তখন গর্ভের শিশুকে একদিকে নাড়ী সম্পূর্ণ ছাড়ছে না। অন্য দিকে ভূমিষ্ঠ হবার বেগ তাকে আকর্ষণ করছে। মুক্তির সঙ্গে বন্ধনের টানাটানির তখনাে কোনাে মীমাংসা হয় নি। এই সময়ের বেদনাই জন্মদানের পূর্বসূচনা, এই বেদনার অভাবকেই চিকিৎসক ভয় করেন। যথার্থ সংশয়ের বেদনও আত্মাকে সত্যের মধ্যে মুক্তিদানের বেদনা। সংসার এক দিকে তাকে আপনার মধ্যে আবৃত আচ্ছন্ন করে রেখেছে, বিমুক্ত সত্য অন্য দিকে তার অলক্ষ্যে তাকে আহবান করছে- সে অন্ধকারের মধ্যেই আছে অথচ আলোককে না জেনেই সে আলোকের আকর্ষণ অনুভব করছে। সে মনে করছে বুঝি তার এই ব্যাকুলতার কোনো পরিণাম নেই, কেননা সে তো সম্মুখে পরিণামকে দেখতে পাচ্ছে না, সে গর্ভস্থ শিশুর মতো নিজের আবরণকেই চার দিকে অনুভব করছে । আসুক সেই অসহ্য বেদনা- সমস্ত প্রকৃতি কঁদিতে থােক- সে কান্নার অবসান হবে । কিন্তু যে-কান্না বেদনায় জেগে ওঠেনি, ফুটে ওঠেনি, জড়তার শত বেষ্টনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে- তার