পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(RVo রবীন্দ্র-রচনাবলী এইখানে দৃষ্টান্তস্বরূপে আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি। আমি নিতান্ত বালককালে মাতৃহীন। আমার বড়ো বয়সের জীবনে মাির অধিষ্ঠান ছিল না। কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম। আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি। গঙ্গার ধারের বাগানবাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন । মা আছেন তো আছেনর্তার আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না । আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে র্তার ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম। বারান্দায় গিয়ে এক মুহূর্তে আমার হঠাৎ কী হল জানি নে— আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে মা আছেন। তখনই তীর ঘরে গিয়ে তীর পায়ের ধুলো নিয়ে তীকে প্ৰণাম করলুম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেন, “তুমি এসেছ!” এইখানেই স্বপ্ন ভেঙে গেল। আমি ভাবতে লাগলুম— মায়ের বাড়িতেই বাস করছি, তার ঘরের দুয়ার দিয়েই দশবার করে আনাগোনা করি— তিনি আছেন এটা জানি সন্দেহ নেই। কিন্তু যেন নেই এমনি ভাবেই সংসার চলছে। তাতে ক্ষতিটা কী হচ্ছে। তার ভাড়ারের দ্বার তিনি বন্ধ করেন নি, তার অন্ন তিনি পরিবেশন করছেন, যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনো তীর পাখা আমাকে বীজন করছে। কেবল ঐটুকু হচ্ছে না, তিনি আমার হাতটি ধরে বলছেন না, তুমি এসেছ! অন্ন জল ধন জন সমস্তই আছে কিন্তু সেই স্বরটি সেই স্পর্শটি কোথায়! মন যখন সম্পূর্ণ জেগে উঠে সেইটিকেই চায় এবং চেয়ে যখন না পায়, কেবল উপকরণভরা ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়ায়, তখন অন্নজল তার আর কিছুতেই রোচে না। একবার ভালো করে ভেবে দেখো, জগতে কোনো জিনিসের কাছে কোনো মানুষের কাছে যাওয়া আমাদের জীবনে অল্পই ঘটে। পরম আত্মীয়ের নিকট দিয়েও আমরা প্রত্যহ আনাগোনা করি বটে কিন্তু দৈবাৎ এক মুহূর্ত তার কাছে গিয়ে পৌঁছেই । কত দিন তার সঙ্গে নিভৃতে কথা কয়েছি এবং সকাল সন্ধ্যার আলোকে একসঙ্গে বেড়িয়েছি। কিন্তু এর মধ্যে হয়তো সকলের চেয়ে কেবল একদিনের কথা মনে পড়ে যেদিন হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। মনে হয়েছে আমি তার কাছে এসেছি। এমন শত সহস্র লোক আছে যারা সমস্ত জীবনে একবারও কোনো জিনিসের কোনো মানুষের কাছে আসে নি। জগতে জন্মেছে কিন্তু জগতের সঙ্গে তাদের অব্যবহিত সংস্পৰ্শ ঘটে নি ।। ঘটে নি যে, এও তারা একেবারেই জানে না । তারা যে সকলের সঙ্গে হাসছে খেলছে গল্পগুজব করছে, নানা লোকের সঙ্গে দেনাপাওনা আনাগোনা চলছে, তারা ভাবছে। এই তো আমি সকলের সঙ্গে আছি । এইরূপ সঙ্গে থাকার মধ্যে সঙ্গটা যে কতই যৎসামান্য সে তার বোধের অতীত । আত্মার দৃষ্টি বাল্যকালে আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি তা জানতুম না। আমি ভাবতুম দেখা বুঝি এই রকমই- সকলে বুঝি এই পরিমাণেই দেখে । একদিন দৈবাৎ লীলাচ্ছলে আমার কোনো সঙ্গীর চশমা নিয়ে চোখে পরেই দেখি, সব জিনিস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তখন মনে হল আমি যেন হঠাৎ সকলের কাছে এসে পড়েছি, সমস্তকে এই যে স্পষ্ট দেখা ও কাছে পাওয়ার আনন্দ, এর দ্বারা বিশ্বভুবনকে যেন হঠাৎ দ্বিগুণ করে লাভ করলুম— অথচ এতদিন যে আমি এত লোকসান বহন করে বেড়াচ্ছি তা জানতুমই না । এ যেমন চোখ দিয়ে কাছে আসা, তেমনি আত্মা দিয়ে কাছে আসা আছে। সেই রকম করে যারই কাছে আসি সেই আমার হাত তুলে ধরে বলে, তুমি এসেছ! এই যে জল বায়ু চন্দ্ৰ সূৰ্য আমাদের পরমবন্ধু, এরা আমাদের নানা কাজ করছে, কিন্তু আমাদের হাত ধরছে না, আনন্দিত হয়ে বলছে না, তুমি এসেছ! যদি তাদের তেমনি কাছে যেতে পারতুম, যদি তাদের সেই স্পর্শ সেই সম্ভাষণ লাভ করতুম তা হলে মুহুর্তের মধ্যে বুঝতে পারতুম, তাদের কৃত সমস্ত উপকারের চেয়ে এইটুকু কত বড়ো। মানুষের মধ্যে আমি চিরজীবন বাস করলুম। কিন্তু মানুষ আমাকে স্পর্শ করে বলছে না, তুমি