পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (Sa এসেছ! আমি একটা আবরণের মধ্যে আবৃত হয়ে পৃথিবীতে সঞ্চরণ করছি। ডিমের মধ্যে পক্ষীশিশু যেমন পৃথিবীতে জন্মেও জন্মলাভ করে না, এও সেই রকম | এই অস্ফুট চেতনার ডিমের ভিতর থেকে জন্মলাভই আধ্যাত্মিক জন্ম। সেই জন্মের দ্বারাই আমরা দ্বিজ হব । সেই জন্মই জগতে যথার্থীরাপে জন্ম— জীবচৈতন্যের বিশ্বচৈতন্যের মধ্যে জন্ম। তখনই পক্ষীশিশু পক্ষীমাতার পক্ষপুটের সম্পূর্ণ সংস্পৰ্শ লাভ করে— তখনই মানুষ সর্বত্রই সেই সর্বকে প্রাপ্ত হয়। সেই প্রাপ্ত হওয়া যে কী আশ্চর্য সার্থকতা কী অনির্বাচনীয় আনন্দ তা আমরা জানি নে, কিন্তু জীবনে কি ক্ষণে ক্ষণে তার আভাসমােত্রও পাই নে ! আধ্যাত্মিকতায় আমাদের আর কিছু দেয় না ; আমাদের ঔদাসীনা আমাদের অসাড়তা ঘুচিয়ে দেয় । অর্থাৎ তখনই আমরা চেতনার দ্বারা চেতনাকে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে পাই | সেই রকম করে যখন পাই তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সমস্তই তার আনন্দরূপ। তৃণ থেকে মানুষ পর্যন্ত জগতে যেখানেই আমার চিত্ত উদাসীন থাকে। সেখানেই আমাদের আধ্যাত্মিকতা সীমাবদ্ধ হয়েছে। এটি জানতে হবে । আমাদের চেতনা আমাদের আত্মা যখন সর্বত্র প্রসারিত হয় তখন জগতের সমস্ত সত্তাকে আমাদের সত্তার দ্বারাই অনুভব করি, ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা নয়, বুদ্ধির দ্বারা নয়, বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা নয়। সেই পরিপূর্ণ অনুভূতি একটি আশ্চর্য ব্যাপার। এই সমুখের গাছটিকেও যদি সেই সত্তারূপে গভীররূপে অনুভব করি তবে যে আমার সমস্ত সত্তা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে । তাই দেখি নে বলে একে চােখ দিয়ে দেখবামাত্র এতে আমার কোনো প্রয়োজন নেই বলে এর সম্মুখ দিয়ে চলে যাই, এই গাছের সত্যে আমার সতাঁকে জাগিয়ে তুলে আমাকে আনন্দের অধিকারী করে না । মানুষকেও আমরা আত্মা দিয়ে দেখি নে—– ইন্দ্ৰিয় দিয়ে যুক্তি দিয়ে স্বার্থ দিয়ে সংসার দিয়ে সংস্কার দিয়ে দেখি- তাকে পরিবারের মানুষ, বা প্রয়োজনের মানুষ, বা নিঃসম্পর্ক মানুষ বা কোনাে-একটা বিশেষ শ্রেণীভুক্ত মানুষ বলেই দেখি- সুতরাং সেই সীমাতেই গিয়ে আমার পরিচয় ঠেকে যায়- সেইখানেই দরজা রুদ্ধ- তার ভিতরে আর প্রবেশ করতে পারি নে— তাকেও আত্মা বলে আমার আত্মা প্ৰত্যক্ষ ভাবে সম্ভাষণ করতে পারে না । যদি পারত। তবে পরস্পর হাত ধরে বলত, তুমি এসেছা! আধ্যাত্মিক সাধনার যে চরম লক্ষ্য কী তা উপনিষদে স্পষ্ট লেখা আছে— তে সর্বগং সর্বতঃ প্রাপ্য ধীরা যুক্তাত্মানং সর্বমেবাবিশন্তি । ধীর ব্যক্তিরা সর্বব্যাপীকে সকল দিক থেকে পেয়ে যুক্তাত্মা হয়ে সর্বত্রই প্রবেশ করেন । এই সর্বত্র প্রবেশ করবার ক্ষমতাই শেষ ক্ষমতা | প্ৰবেশ করার মানেই হচ্ছে যুক্তাত্মা হওয়া । যখন সমস্ত পাপের সমস্ত অভ্যাসের সংস্কারের আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের আত্মা সর্বত্রই আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয় তখনই সে সর্বত্র প্রবেশ করে— সেই আত্মায় গিয়ে না পৌছেলে সে দ্বারে এসে ঠেকে- সে মৃত্যুতেই আবদ্ধ হয়, অমৃতং যদ্বিভাতি, অমৃতরূপে যিনি সকলের মধ্যেই প্রকাশমান, সেই অমৃতের মধ্যে আত্মা পৌছোতে পারে না- সে আর সমস্তই দেখে কেবল আনন্দরূপমমৃতং দেখে না । এই যে আত্মা দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র আত্মার মধ্যে প্রবেশ করা এই তো আমাদের সাধনার লক্ষ্য । প্রতিদিন এই পথেই যে আমরা চলছি। এটা তো আমাদের উপলব্ধি করতে হবে । অন্ধভাবে জড়ভাবে তো এটা হবে না । চেতন ভাবেই তো চেতনার বিস্তার হতে থাকবে । প্রতিদিন তো আমাদের বুঝতে হবে- একটু একটু করে আমাদের প্রবেশপথ খুলে যাচ্ছে, আমাদের অধিকার ব্যাপ্ত হচ্ছে। সকলের সঙ্গে বেশি করে মিলতে পাচ্ছি, অল্পে অল্পে সমস্ত বিরোধ কেটে যাচ্ছে— মানুষের সঙ্গে মিলনের - মধ্যে, সংসারের কর্মের মধ্যে, ভূমার প্রকাশ প্রতিদিন অব্যাহত হয়ে আসছে। আমিত্ব বলে যে সুদুর্ভেদ্য আবরণ আমাকে সকলের সঙ্গে অত্যন্ত বিভক্ত করে রেখেছিল তা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে, ক্রমেই তা স্বচ্ছ হয়ে তার ভিতর থেকে নিখিলের আলো ক্ৰমে ক্রমে ফুটতর হয়ে দেখা যাচ্ছে- আমি আমার দ্বারা কাউকে আচ্ছন্ন কাউকে বিকৃত করছি নে, আমার মধ্যে অন্যের এবং অন্যের মধ্যে আমার বাধা প্ৰত্যহই কেটে যাচ্ছে ।