পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আপনিই আপনার জবাবদিহি, আপনিই আপনার লক্ষ্য । যদি বল, ত্যাগের দ্বারা ত্যক্তবস্তু থেকে মুক্তিলাভ করবে, তাতে আমাদের মন সায় দেয় না, যদি বল, ত্যাগের দ্বারা ত্যক্তবস্তুকে পূর্ণতররূপে লাভ করবে তা হলেও আমাদের মনের সম্পূর্ণরূপে সাড়া পাওয়া যায় না। যদি বল, ত্যাগের দ্বারা প্রেমকে পাওয়া যাবে, তা হলে মন আর কথাটি কইতে পাৱে এ কথাটাকে যদি সে ঠিকমত অবধান করে শোনে তবে তাকে বলে উঠতেই হবে, “তা হলে যে ত্যাগের সঙ্গে প্রেমের ভারি একটা সম্বন্ধ আছে- এমন সম্বন্ধ যে, কে আগে কে পরে তা ঠিক করাই দায় । প্রেম ছাড়া ত্যাগ হয় না, আবার ত্যাগ ছাড়া প্রেম হতে পারে না । যা আমাদের কাছ থেকে প্রয়ােজনের তাগিদে বা অত্যাচারের তাড়নায় ছিনিয়ে নেওয়া হয় সে তো ত্যাগই নয়—আমরা প্রেমে যা দিই তাই সম্পূর্ণ দিই, কিছুই তার আর রাখি নে, সেই দেওয়াতেই দানকে সার্থক মনে করি। কিন্তু এই যে প্ৰেম এও ত্যাগের সাধনাতেই শেষে আমাদের কাছে ধরা দেয় । যে লোক চিরকাল কেবল আপনার দিকেই টানে, নিজের অহংকারকেই জয়ী করবার জন্যে ব্যস্ত সেই স্বার্থপর সেই দাম্ভিক ব্যক্তির মনে প্রেমের উদয় হয় না— প্রেমের সূর্য একবারে কুহেলিকায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। স্বার্থের বন্ধন ছাড়তে হবে, অহংকারের নাগপাশ মোচন করতে হবে, যা কেবল জমাবার জন্যেই জীবনপাত করেছি। প্রত্যহ তা ত্যাগ করতে বসতে হবে— ত্যাগটা যেন ক্রমশই সহজ হয়ে আসে, নিজের দিকের টানটা যেন প্রত্যহই আলগা হয়ে আসে। তা হলেই কি যাকে মুক্তি বলে তাই পাব। হাঁ, মুক্তি পাবে। মুক্তি পেয়ে কী পাব। মুক্তির যা চরম লক্ষ্য সেই প্রেমকে পাব। প্রেম কে ? তিনিই প্ৰেম, যিনি কোনো প্রয়োজন নেই। তবু আমাদের জন্য সমস্তই ত্যাগ করছেন, তিনিই প্রেমস্বরূপ । তিনি নিজের শক্তিকে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের ভিতর দিয়ে নিয়ত আমাদের জন্য উৎসর্জন করছেন— সমস্ত সৃষ্টি তীর কৃত উৎসর্গ। আনন্দাদ্ধোব খন্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে— আনন্দ থেকেই এই যা কিছু সমস্ত সৃষ্টি হচ্ছে, দায়ে পড়ে কিছুই হচ্ছে না— সেই স্বয়ম্ভ সেই স্বতউৎসারিত প্রেমই সমস্ত সৃষ্টির মূল । এই প্রেমস্বরূপের সঙ্গে আমাদের সম্পূর্ণ যোগ হলেই আমাদের সমুদয় ইচ্ছার পরিপূর্ণ চরিতার্থতা হবে । সম্পূর্ণ যোগ হতে গেলেই যার সঙ্গে যার যোগ হবে তার মতন হতে হবে । প্রেমের সঙ্গে প্রেমের দ্বারাই যোগ হবে । কিন্তু প্রেম যে মুক্ত, সে যে স্বাধীন । দাসত্বের সঙ্গে প্রেমের আর কোনো তফাতই নেই- কেবল দাসত্ব বদ্ধ আর প্রেম মুক্ত। প্রেম নিজের নিয়মেই নিজে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত, সে নিজের চেয়ে উপরের আর কারও কাছে কোনো বিষয়ে কোনো কৈফিয়ত দেয় না । সুতরাং প্রেমস্বরূপের সঙ্গে মিলতে গেলে আমাদের সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে হবে। স্বাধীন ছাড়া স্বাধীনের সঙ্গে আদান প্ৰদান চলতে পারে না । তার সঙ্গে আমাদের এই কথাবার্তা হয়ে গেছে, তিনি আমাদের বলে রেখেছেন, তুমি মুক্ত হয়ে আমার কাছে এসো- যে ব্যক্তি দাস তার জন্য আমার আম-দরবার খোলা আছে বটে কিন্তু সে আমার খাস-দরবারে প্রবেশ করতে পারবে না । এক এক সময় মনের আগ্রহে আমরা তার সেই খাস-দরবারের দরজার কাছে ছুটে যাই- কিন্তু দ্বারা বার বার আমাদের ফিরিয়ে দেয়। বলে, তোমার নিমন্ত্রণ পত্র কই । খুঁজতে গিয়ে দেখি আমার কাছে যে কটা নিমন্ত্রণ আছে সে ধনের নিমন্ত্রণ, যশের নিমন্ত্রণ, অমৃতের নিমন্ত্রণ নয়। বার বার ফিরে আসতে হল- বার বার ! টিকিট-পরীক্ষককে ফাকি দেবার জো নেই। আমরা দাম দিয়ে যে ইস্টেশনের টিকিট কিনেছি সেই ইস্টেশনেই আমাদের নামতে হবে। আমরা বহুকালের সাধনা এবং বহুদুঃখের সঞ্চয় দিয়ে এই সংসার লাইনেরই নানা গম্যস্থানের টিকিট কিনেছি। অন্য লাইনে তা চলবে না । এবার থেকে প্রতিদিন আবার অন্য লাইনের টাকা সংগ্ৰহ করতে হবে। এবার থেকে যা কিছু সংগ্রহ এবং যা কিছু ত্যাগ করতে হবে সে কেবল সেই প্রেমের জন্যে ।