পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন ○○a আমরা চাই। যে চাওয়াতে আমাদের ভিতরকার এই দুই চাওয়ারই সম্পূৰ্ণ সামঞ্জস্য হয়, সেই হচ্ছে প্রেমের চাওয়া । বন্ধনকে স্বীকার করে বন্ধনকে অতিক্রম করব, এই হচ্ছে প্রেমের কাজ । প্রেম যেমন স্বাধীন এমন স্বাধীন আর দ্বিতীয় কেউ নেই, আবার প্রেমের যে অধীনতা এতবড়ো অধীনতাই বা । জগতে কোথায় আছে । অধীনতা জিনিসটা যে কত বড়ো মহিমান্বিত বৈষ্ণবধর্মে সেইটাে আমাদের দেখিয়েছে। অদ্ভুত সাহসের সঙ্গে অসংকোচে বলেছে, ভগবান জীবের কাছে নিজেকে বাধা রেখেছেন— সেই পরম গৌরবের উপরেই জীবের অস্তিত্ব। আমাদের পরম অভিমান এই যে, তিনি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারেন নি— এই বন্ধনটি তিনি মেনেছেন— নইলে আমরা আছি কি করে । মা যেমন সন্তানের, প্রণয়ী যেমন প্রণয়ীর সেবা করে তিনি তেমনি বিশ্ব জুড়ে আমাদের সেবা করছেন । তিনি নিজে সেবক হয়ে সেবা-জিনিসকে অসীম মাহাত্ম্য দিয়েছেন । তার প্রকাণ্ড জগৎটি নিয়ে তিনি তো খুব ধুমধাম করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের মন ভোলাবার এত চেষ্টা কেন ? নানা ছলে নানা কলায় বিশ্বের সঙ্গে আমাদের এত অসংখ্য ভালো লাগাবার সম্পর্ক পাতিয়ে দিচ্ছেন কেন ? এই ভালো লাগাবার অপ্রয়োজনীয় আয়োজনের কি অন্ত আছে ? তিনি নানা দিক থেকে কেবলই বলছেন, তোমাকে আমার আনন্দ দিচ্ছি, তোমার আনন্দ আমাকে দাও । তিনি যে নিজেকে চারি দিকেই সীমার অপরূপ ছন্দে বেঁধেছেন— নইলে প্রেমের গীতিকাব্য প্ৰকাশ হয় না যে | এই প্রেমস্বরূপের সঙ্গে আমাদের প্ৰেম যেখানেই ভালো করে না মিলছে সেইখানে সমস্ত জগতে তার বেসুরটা বাজছে। সেইখানে কত দুঃখ যে জাগছে তার সীমা নেই- চােখের জল বয়ে যাচ্ছে। ওগো প্রেমিক, তুমি যে প্রেম কেড়ে নেবে না, তুমি যে মন ভুলিয়ে নেবে- একদিন সমস্ত মনে প্ৰাণে কঁদিয়ে তার পরে তোমার প্রেমের ঋণ শোধ করাবে । তাই এত বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে- তাই তো, সন্ধ্যা হয়ে আসে। তবু আমার অভিসারের সজা হল না। Ss als: S0SG কী চাই ? আমরা এতদিন প্রত্যহ আমাদের উপাসনা থেকে কী ফল চেয়েছিলুম। আমরা চেয়েছিলুম শান্তি । ভেবেছিলুম, এই উপাসনা বনস্পতির মতো আমাদের ছায়া দেবে, প্রতিদিন সংসারের তাপ থেকে আমাদের বাচাবে । কিন্তু শান্তিকে চাইলে শান্তি পাওয়া যায় না । তার চেয়ে আরো অনেক বেশি না চাইলে শান্তির প্রার্থনাও বিফল হয় । জ্বরের রোগী কাতর হয়ে বলে, আমার এই জ্বালাটা জুড়োক ; হয়তো জলে ঝাপ দিয়ে পড়ে । তাতে যেটুকু শান্তি হয় সেটা তো স্থায়ী হয় না— এমনকি, তাতে তাপ বেড়ে যেতে পারে। রোগী যদি শান্তি চায়, স্বাস্থ্য না চায়, তবে সে শান্তিও পায় না, স্বাস্থ্যও পায় না। আমাদেরও শান্তিতে চলবে না, প্রেম দরকার। বরঞ্চ মনে ঐ যে একটুকু শান্তি পাওয়া যায়, কিছুক্ষণের জন্য একটা স্নিগ্ধতার আবরণ আমাদের উপরে এসে পড়ে, সেটাতে আমাদের ভুলায়— আমরা মনে নিশ্চিন্ত হয়ে বলি, আমাদের উপাসনা সার্থক হল- কিন্তু ভিতরের দিকে সার্থকতা দেখতে পাই নে । কেননা, দেখতে পাই, ব্যাধি যে যায় না। সমস্ত দিন নানা ঘটনায় দেখতে পাই, সংসারের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ সহজ হয় নি। রোগীর সঙ্গে তার বাহিরের প্রকৃতির সম্বন্ধ যেরকম সেইরকম হয়ে আছে। বাহিরে যেখানে সামান্য ঠাণ্ডা, রোগীর দেহে সেখানে অসহ্য শীত ; বাহিরের স্পর্শ যেখানে