পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

や S \, (r. 3 (? এতবড়ো জগতের সামনে আমাদের এই দুটি চােখের পাতা খুলে গেছে ? এ জেনেই বা কী হবে । জেনে হয়তো অনেক লাভ হতে পারে, কিন্তু জানার লাভ সে তো জানারই লাভ ; তাতে জ্ঞানের তহবিল পূর্ণ হচ্ছে— তা হােক। কিন্তু আমি যে বলছি চােখের দেখার কথা । আমি বলছি, এই চোখেই আমরা যা দেখতে পাব তা এখনো পাই নি । আমাদের সামনে আমাদের চার দিকে যা আছে তার কোনোটাকেই আমরা দেখতে পাই নি— ঐ তৃণটিকেও না। আমাদের মনই আমাদের চােখকে চেপে রয়েছে- সে যে কত মাথামুণ্ড ভাবনা নিয়ে আছে তার ঠিকানা নেই- সেই অশনিবাসনের ভাবনা নিয়ে সে আমাদের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে রেখেছে— সে কত লোকের মুখ থেকে কত সংস্কার নিয়ে জমা করেছে— তার যে কত বাধা শব্দ আছে, কত বাধা মত আছে তার সীমা নেই, সে কাকে যে বলে শরীর কাকে যে বলে আত্মা, কাকে যে বলে হেয় কাকে যে বলে শ্রেয়, কাকে যে বলে সীমা কাকে যে বলে অসীম তার ঠিকানা নেই— এই সমস্ত সংস্কারের দ্বারা চাপা দেওয়াতে আমাদের দৃষ্টি নির্মল নিমুক্ত ভাবে জগতের সংস্রব লাভ করতেই পারে না । আলোক তাই প্রত্যহই আমাদের চক্ষুকে নিদ্রািলসতা থেকে ধৌত করে দিয়ে বলছে, তুমি স্পষ্ট করে দেখো, তুমি নির্মল হয়ে দেখো, পদ্ম যে-রকম সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে সূর্যকে দেখে তেমনি করে দেখো । কাকে দেখবে । তাকে, র্যাকে ধ্যানে দেখা যায় ? না, তাকে না, র্যাকে চোখে দেখা যায়। তাকেই | সেই রূপের নিকেতনকে, যার থেকে গণনাতীত রূপের ধারা অনন্ত কাল থেকে ঝরে পড়ছে। চারি দিকেই রূপ— কেবলই এক রূপ থেকে আর-এক রূপের খেলা ; কোথাও তার আর শেষ পাওয়া যায় নাদেখেও পাই নে, ভেবেও পাই নে ! রূপের ঝরনা দিকে দিকে থেকে কেবলই প্রবাহিত হয়ে সেই অনন্তরূপসাগরে গিয়ে ঝাপ দিয়ে পড়ছে । সেই অপরূপ অনন্তরূপকে তার রূপের লীলার মধ্যেই যখন দেখব। তখন পৃথিবীর আলোকে একদিন আমাদের চােখ মেলা সার্থক হবে, আমাদের প্রতিদিনকার আলোকের অভিষেক চরিতার্থ হবে । আজ যা দেখছি, এই যে চারি দিকে আমার যে-কেউ আছে, যা-কিছু আছে, এদের একদিন যে কেমন করে, কী পরিপূর্ণচৈতনাযোগে দেখব তা আজ মনে কবতে পারি নে— কিন্তু এটুকু জানি, আমাদের এই চােখের দেখার সামনে সমস্ত জগৎকে সাজিয়ে আলোক আমাদের কাছে যে আশার বার্তা আনছে, তা এখনো কিছুই সম্পূর্ণ হয় নি । এই গাছের রূপটি যে তার আনন্দরূপ, সে-দেখা এখনো আমাদের দেখা হয় নি- মানুষের মুখে যে তীর অমৃতরূপ, সে-দেখার এখনো অনেক বাকি— “আনন্দরূপমমৃতং” এই কথাটি যেদিন আমার এই দুই চক্ষু বলবে সেইদিনই তারা সার্থক হবে । সেইদিনই তার সেই পরমসুন্দর প্রসন্নমুখ, তার দক্ষিণং মুখং একেবারে আকাশে তাকিয়ে দেখতে পাব | তখনই সর্বত্রই নমস্কারে আমাদের মাথা নত হয়ে পড়বে— তখন ওষধিবনস্পতির কাছেও আমাদের স্পর্ধা থাকবে না— তখন আমরা সত্য করে বলতে পারব, যে বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ, যা ওষধিযু যে বনস্পতিযু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ । ৪ পৌষ (*ोनों কাল সন্ধ্যা থেকে এই গানটি কেবলই আমার মনের মধ্যে ঝংকৃত হচ্ছে— “বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে ।” আমি কোনােমতেই ভুলতে পারছি নে— বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে । অমল কমল-মাঝে, জ্যোৎস্না রজনী-মাঝে, কাজল ঘন-মাঝে, নিশি-আঁধারি-মাঝে, কুসুমসুরভি-মাঝে বীণ-রণন শুনি যে প্ৰেমে প্ৰেমে বাজে ।