পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ 8 2 রবীন্দ্র-রচনাবলী কাল রাত্রে ছাদে দাড়িয়ে নক্ষত্ৰলোকের দিকে চেয়ে আমার মন সম্পূর্ণ স্বীকার করেছে, “বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে ।” এ কবিকথা নয়, এ বাক্যালংকার নয়— আকাশ এবং কালকে পরিপূর্ণ করে অহােরাত্ৰ সংগীত বেজে উঠছে । বাতাসে যখন ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউ সুন্দর করে খেলিয়ে ওঠে তখন তাদের সেই আশ্চর্য মিলন এবং সৌন্দর্যকে আমাদের চোখ দেখতে পায় না, আমাদের কানের মধ্যে সেই লীলা গান হয়ে প্রকাশ পায় । আবার আকাশের মধ্যে যখন আলোর ঢেউ ধারায় ধারায় বিচিত্র তালে নৃত্য করতে থাকে তখন সেই অপরূপ লীলার কোনো খবর আমাদের কান পায় না, চোখের মধ্যে সেইটে রূপ হয়ে দেখা দেয় । যদি এই মহাকাশের লীলাকেও আমরা কানের সিংহদ্বার দিয়ে অভ্যর্থনা করতে পারতুম তা হলে বিশ্ববীণার এই ঝংকারকে আমরা গান বলেও চিনতে পারতুম | এই প্ৰকাণ্ড বিপুল বিশ্ব-গানের বন্যা যখন সমস্ত আকাশ ছাপিয়ে আমাদের চিত্তের অভিমুখে ছুটে আসে তখন তাকে এক পথ দিয়ে গ্রহণ করতেই পারি নে, নানা দ্বার খুলে দিতে হয় চোখ দিয়ে, কান দিয়ে, নাক দিয়ে, স্পর্শেন্দ্ৰিয় দিয়ে, নানা দিক দিয়ে তাকে নানারকম করে নিই। এই একতান মহাসংগীতকে আমরা দেখি, শুনি, ছুই, শুকি, আস্বাদন করি । এই বিশ্বের অনেকখানিকেই যদিও আমরা চোখে দেখি, কানে শুনি নে, তবুও বহুকাল থেকে অনেক কবি এই বিশ্বকে গানই বলেছেন। গ্রীসের ভাবুকেরা আকাশে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গতায়াতকে নক্ষত্ৰলোকের গান বলেই বর্ণনা করেছেন । কবিরা বিশ্বভুবনের রূপবিন্যাসের সঙ্গে চিত্রকলার উপমা অতি অল্পই দিয়েছেন তার একটা কারণ, বিশ্বের মধ্যে নিয়ত একটা গতির চাঞ্চল্য আছে। কিন্তু শুধু তাই নয় — এর মধ্যে গভীরতর একটা কারণ আছে । ছবি যে আঁকে তার পট চাই, তুলি চাই, রঙ চাই, তার বাইরের আয়োজন অনেক । তার পরে সে যখন আঁকতে থাকে তখন তার আরম্ভের রেখাতে সমস্ত ছবির আনন্দ দেখা যায় না— অনেক রেখা এবং অনেক বর্ণ মিললে পর তবেই পরিণামের আভাস পাওয়া যায় । তার পরে আঁকা হয়ে গেলে, চিত্রকর চলে গেলেও সে ছবি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে- চিত্রকরের সঙ্গে তার আর কোনো একান্ত সম্বন্ধ থাকে না | কিন্তু যে গান করে গানের সমস্ত আয়োজন তার নিজেরই মধ্যে— আনন্দ যার, সুর তারই কথাও তারা- কোনোটাই বাইরের নয় । হৃদয় যেন একেবারে অব্যবহিতভাবে নিজেকে প্রকাশ করে, কোনো উপকরণের ব্যবধানও তার নেই। এইজন্যে গান যদিচ একটা সম্পূর্ণতার অপেক্ষা রাখে, তবু তার প্রত্যেক অসম্পূর্ণ সুরটিও হৃদয়কে যেন প্রকাশ করতে থাকে। হৃদয়ের এই প্রকাশে শুধু যে উপকরণের ব্যবধান নেই, তা নয়- কথা জিনিসটাও একটা ব্যবধান- কেননা ভেবে তার অর্থ বুঝতে হয়— গানে সেই অর্থ বোঝবারও প্রয়োজন নেই— কোনো অর্থ না থাকলেও কেবলমাত্র সুরেই যা বলবার তা অনির্বচনীয় রকম করে বলে । তার পরে আবার গানের সঙ্গে গায়কের এক মুহুৰ্তও বিচ্ছেদ নেই— গান ফেলে রেখে গায়ক চলে গেলে, গানও তার সঙ্গে সঙ্গেই চলে যায়। গায়কের প্রাণের সঙ্গে শক্তির সঙ্গে আনন্দের সঙ্গে গানের সুর একেবারে চিরমিলিত হয়েই প্রকাশ পায় । যেখানে গান সেখানেই গায়ক, এর আর কোনো ব্যত্যয় নেই । এই বিশ্বসংগীতটিও তার গায়ক থেকে এক মুহূর্তও ছাড়া নেই। তীর বাইরের উপকরণ থেকেও এ গড়া নয় । একেবারে তারই চিত্ত তারই নিশ্বাসে তারই আনন্দ রূপ ধরে উঠছে। এ গান একেবারে সম্পূর্ণ হয়ে তীর অন্তরে রয়েছে, অথচ ক্রমাভিব্যক্তিরূপে প্রকাশ পাচ্ছে, কিন্তু এর প্রত্যেক সুরই সেই সম্পূর্ণ গানের আবির্ভাব | এক সুরকে আর এক সুরের সঙ্গে আনন্দে সংযুক্ত করে চলেছে। এই বিশ্বগানের যখন কোনো বচনগম্য অর্থও না পাই তখনো আমাদের চিত্তের কাছে এর প্রকাশ কোনো বাধা পায় না । এ যে চিত্তের কাছে চিত্তের অব্যবহিত প্ৰকাশ । গায়ত্রীমন্ত্রে তাই তো শুনতে পাই, সেই বিশ্বসবিতার ভৰ্গ। র্তার তেজ তীর শক্তি ভুর্ভুবঃ স্বঃ হয়ে কেবলই উচ্ছসিত হয়ে উঠছে এবং তারই সেই এক শক্তি কেবলই ধীরূপে আমাদের অন্তরে বিকীর্ণ