পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(28br রবীন্দ্র-রচনাবলী এইজনাই সত্যের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধির যোগ আছে এবং তার প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ নির্ভর আছে। গাছের যেমন গোড়াতেই দরকার শিকড় দিয়ে ভূমিকে আঁকড়ে ধরা, আমাদেরও তেমনি গোড়ার প্রয়ােজন হচ্ছে স্কুল সূক্ষ্ম অসংখ্য শিকড় দিয়ে সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠা লাভ করা। আমরা ইচ্ছা করি না করি, এ সাধনা আমাদের করতেই হয়। শিশু বলে, আমি পা ফেলে চলব। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বহু সাধনায় সে চলার নিয়মটিকে পালন করে ভারাকর্ষণের সঙ্গে আপাস করতে না পারে ততক্ষণ তার আর উপায় নেই— শুধু বললেই হবে না, আমি চলব। এই চলবার নিয়মকে শিশু যখনই গ্রহণ করে এ-নিয়ম আর তখন তাকে পীড়া দেয় না। শুধু যে পীড়া দেয় না, তা নয় ; তাকে আনন্দ দেয় ; সত্য-নিয়মের বন্ধনকে স্বীকার করবামাত্রই শিশু নিজের এমনি করে ক্রমে ক্রমে যখন সে জলের সত্য, মাটির সত্য, আগুনের সত্যকে সম্পূর্ণ মানতে শেখে তখন যে কেবল তার কতকগুলি অসুবিধা দূর হয় তা নয়, জল মাটি আগুন সম্বন্ধে তার শক্তি সফল হয়ে উঠে তাকে আনন্দ দেয় । শুধু বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে নয়, সমাজের সঙ্গেও শিশুকে সত্যসম্বন্ধে যুক্ত হয়ে ওঠবার জন্যে বিস্তর সাধনা করতে হয়, তাকে বিস্তর নিয়ম স্বীকার করতে হয়- তাকে অনেকরকম আবদার থামাতে হয়, অনেক রাগ কমাতে হয়।— নিজেকে অনেকরকম করে বাধতে হয় এবং অনেকের সঙ্গে বাধতে হয় । যখন এই বন্ধনগুলি মানা তার পক্ষে সহজ হয় তখন সমাজের মধ্যে বাস করা তার পক্ষে আনন্দের হয়ে ওঠে- তখনই তার সামাজিক শক্তি সেই-সকল বিচিত্র নিয়মবন্ধনের সাহায্যেই বাধামুক্ত হয়ে স্মৃর্তিলাভ করে। এমনি করে অধিকাংশ মানুষই যখন বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এবং সমাজের মধ্যে মোটামুটি রকমে চলনসই হয়ে ওঠে তখনই তারা নিশ্চিন্ত হয়, এবং নিজেকে অনিন্দনীয় মনে করে খুশি হয়। কিন্তু এমন টাকা আছে যা গায়ে চলে কিন্তু শহরে চলে না, শহরের বাজে দোকানে চলে যায় কিন্তু ব্যাঙ্কে চলে না | ব্যাঙ্কে তাকে ভাঙাতে গেলেই সেখানে যে পোদ্যারটি আছে সে একেবারে স্পর্শমাত্রেই তাকে তৎক্ষণাৎ মেকি বলে বাতিল করে দেয় । আমাদেরও সেই দশা— আমরা ঘরের মধ্যে, গায়ের মধ্যে, সমাজের মধ্যে নিজেকে চলনসই করে রেখেছি কিন্তু বড়ো ব্যাঙ্কে যখন দাড়াই তখনই পোদারের কাছে এক মুহূর্তে আমাদের সমস্ত খাদ ধরা পড়ে যায়। সেখানে যদি চলতি হতে চাই। তবে সত্য হতে হবে, আরো সত্য হতে হবে । আরো অনেক বাধনে নিজেকে বাঁধতে হবে, আরো অনেক দায় মানতে হবে । সেই অমৃতের বাজারে এতটুকু মেকিও চলে না- একেবারে খাটি সত্য না হলে অমৃত কেনবার আশা করাও যায় না। তাই বলছিলুম কেবল অমৃত্যুরসের কথা তো বললেই হবে না, তার হিসাবটাও দেখতে হবে । আমরা নিজের হিসাব যখন মেলাতে বসি তখন দু-চার টাকার গরমিল হলেও বলি ওতে কিছু আসে যায় না। এমনি করে নোেজই গরমিলের অংশ কেবলই জমে উঠছে। প্রকৃতির সঙ্গে এবং মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে প্রত্যহই ছোটােবড়ো কত অসত্য কত অন্যায়ই চালিয়ে দিচ্ছি সে-সম্বন্ধে যদি কথা ওঠে তো বলে বসি, আমন তো আকসার হয়েই থাকে, অমন তো কত লোকেই করে- ওতে করে এমন ঘটে না যে আমি ভদ্রসমাজের বার হয়ে যাই । ঘরো হিসাবের খাতায় এইরকম শৈথিল ঘটে। কিন্তু যারা জাতিতে সাধু, যারা মহাজন, তারা লাখটাকার কারবারে এক পয়সার হিসাবটি না মিললে সমস্ত রাত্রি ঘুমোতে পারে না । যারা মস্ত লাভের দিকে তাকিয়ে আছে তারা ছোট্ট গরমিলকেও ডরায়- তারা হিসাবকে একেবারে নিখুঁত সত্য না করে বঁাচে না । তাই বলছিলুম, সেই যে পরম রস, প্ৰেমরস— তার মহাজন যদি হতে চাই। তবে হিসাবের খাতাকে নীরস বলে একটু ফাকি দিলেও চলবে না। যিনি অমৃতের ভাণ্ডারী তার কাছে বেহিসাবি আবদার