পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (8) একেবারেই খাটবে না। তিনি যে মস্ত হিসাবি– এই প্ৰকাণ্ড জগদব্যাপারে কোথাও হিসাবের গোল হয় না— তার কাছে কোন লজ্জায় গিয়ে বলব, আমি আর কিছু জানি নে, আর কিছু মানি নে, আমাকে কেবল প্রেম দাও, আমাকে প্রেমে মাতাল করে তোলো । আত্মা যেদিন অমৃতের জন্যে কেঁদে ওঠে তখন সর্বপ্রথমেই বলে— অসতাে মা সদগময়— আমার জীবনকে আমার চিত্তকে সমস্ত উচ্ছঙ্খল অসত্য হতে সত্যে বেঁধে ফেলো। অমৃতের কথা তার পরে ! আমাদেরও প্রতিদিন সেই প্রার্থনাই করতে হবে, বলতে হবে, অসতাে মা সদগময়— বন্ধনহীন অসংযত অসত্যের মধ্যে আমাদের মন হাজার টুকরো করে ছড়িয়ে ফেলতে দিয়াে না— তাকে অটুট সত্যের সূত্রে সম্পূৰ্ণ করে বেঁধে ফেলো- তার পরে সে হার তোমার গলায় যদি পরাতে চাই। তবে আমাকে লজা পেতে হবে না । ৬। পৌষ শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষের উৎসব ల్లా তো আমরা রচনা করতে পারি নে, যদি সুযোগ হয় তবে উৎসব আমরা আবিষ্কার করতে 5 সত্য যেখানেই সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব । সে প্রকাশ কবেই বা বন্ধ আছে। পাখি তো রোজই ভোর রাত্রি থেকেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে তার সকালবেলাকার গীতোৎসবের নিত্য নিমন্ত্রণ রক্ষা করবার জন্যে। আর প্রভাতের আনন্দসভাটিকে সাজিয়ে তোেলবার জন্য একটি অন্ধকার পুরুষ সমস্ত রাত্ৰি কত যে গোপন আয়োজন করে তার কি সীমা আছে | শুতে যাবার আগে একবার যদি কেবল তাকিয়ে দেখি, তবে দেখতে পাই নে কি জগতের নিত্য উৎসবের মহাবিজ্ঞাপন সমস্ত আকাশ জুড়ে কে টাঙিয়ে দিয়েছে । এর মধ্যে আমাদের উৎসবটা কবে ? যেদিন আমরা সময় করতে পারি। সেই দিন । যেদিন হঠাৎ ইশ হয় যে আমাদের নিমন্ত্রণ আছে এবং সে নিমন্ত্রণ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে । যেদিন স্নান করে সাজ করে ঘর ছেড়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি । সেই দিন উৎসবের সকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি— বাঃ আজ আলোটি কী মধুর, কী পবিত্র । আরো মূঢ়, এ আলো কবে মধুর ছিল না, কবে পবিত্র ছিল না । তুমি একটা বিশেষ দিনের গায়ে একটা বিশেষ চিহ্ন কেটে দিয়েছ বলেই কি আকাশের আলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলেছে । আর কিছু নয়— আজকে নিমন্ত্রণরক্ষা করতে এসেছি অন্যদিন করি নি, এইমাত্র তফাত । আয়োজনটা এমনিই প্রতিদিনই ছিল, প্রতিদিনই আছে | জগৎ যে আনন্দরূপ, এইটে আজ দেখব বলে কাজকর্ম ফেলে এসেছি। শুধু তাই নয়, আমিও নিজের আনন্দময় স্বরূপটিকেই ছুটি দিয়েছি ; আজ বলেছি, থাক আজ দেনাপাওনার টানাটানি, ঘুচুক আজ আত্মপরের ভেদ, মরুক আজ সমস্ত কার্পণ্য, বাহির হােক আজ যত ঐশ্বৰ্য আছে। যে আনন্দ জলে স্থলে আকাশে সর্বত্র বিরাজমান সেই আনন্দকে আজ আমার আনন্দনিকেতনের মধ্যে দেখব । যে উৎসব নিখিলের উৎসব সেই উৎসবকে আজ আমার উৎসব করে তুলব। বিশ্বের একটা মহল তো নয় । তার নানা মহলে নানারকম উৎসবের ব্যবস্থা হয়ে আছে ৷ সজনে নির্জনে নানাক্ষেত্রে উৎসবের নানা ভিন্ন ভাব, আনন্দের নানা ভিন্ন মূর্তি | নীলাকাশতলে প্রসারিত প্রাস্তরের মাঝখানে এই ছায়াস্নিগ্ধ নিভৃত আশ্রমের যে প্রাতাহিক উৎসব, আমরা আশ্রমের আশ্রিতগণ কি সেই উৎসবে সূর্যতারা ও তরুশ্রেণীর সঙ্গে কোনােদিন যোগ দিয়েছি ? আমরা এই আশ্রমটিকে কি তার সমস্ত সত্যে ও সৌন্দর্যে দেখেছি। দেখি নি । এই আশ্রমের মাঝখানে থেকেও আমরা প্রতিদিন