পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( (S রবীন্দ্র-রচনাবলী দিনটিকে যেন আমাদের অন্যমনস্ক জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে না। রাখি— একে ভক্তিপূর্বক সমােদর করে ভিতরে ডেকে নাও, আমাদের তুচ্ছ জীবনের প্রতিদিনের যে দৈনা তাকে সম্পদে পূর্ণ করে । হে দীক্ষাদাতা, হে গুরু, এখনো যদি প্রস্তুত হয়ে না থাকি তো প্রস্তুত করো, আঘাত করো চেতনাকে সর্বত্র উদ্যত করো।— ফিরিয়ে দিয়ে না, ফিরিয়ে দিয়ে না— দুর্বল ব'লে তোমার সভাসদুদের সকলের পশ্চাতে ঠেলে রেখো না | এই জীবনে সত্যকে গ্রহণ করতেই হবে।— নিৰ্ভয়ে এবং অসংকোচে । অসত্যের স্তুপাকার আবর্জনার মধ্যে ব্যর্থ জীবনকে নিক্ষেপ করব না। দীক্ষা গ্ৰহণ করতে হবে- তুমি শক্তি দাও । ৭ পৌষ মানুষ কালকের উৎসবমেলার দোকানি পসারিরা এখনো চলে যায় নি । সমস্ত রাত তারা এই মাঠের মধ্যে আগুন জ্বেলে গল্প করে গান গেয়ে বাজনা বাজিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে । কৃষ্ণচতুর্দশীর শীতরীত্রি । আমি যখন আমাদের নিত্য উপাসনার স্থানে এসে বসলুম তখনো রাত্রি প্রভাত হতে বিলম্ব আছে ; চারি দিকে নিবিড় অন্ধকার— এখানকার ধূলিবাম্পশন স্বচ্ছ আকাশের তারাগুলি দেবচক্ষুর অক্লিষ্ট জাগরণের মতো অক্লান্তভাবে প্রকাশ পাচ্ছে । মাঠের মাঝে মাঝে আগুন জুলছে, ভাঙামেলার লোকেরা শুকনো পাতা জ্বলিয়ে আগুন পোয়াচ্ছে । অনাদিন এই ব্ৰাহ্মমুহুর্তে কী শান্তি, কী স্তব্ধতা । বাগানের সমস্ত পাখি জেগে গেয়ে উঠলেও সে স্তব্ধতা নষ্ট হয় না— শালবনের মর্মরত পল্লবরাশির মধ্যে পৌষের উত্তরে হাওয়া দুরন্ত হয়ে উঠলেও সেই শান্তিকে স্পর্শ করে না । কিন্তু কয়জন মানুষে মিলে যখন কলরব করে তখন প্রভাত প্রকৃতির এই স্তব্ধতা কেন এমন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। উপাসনার জনো সাধক পশুপক্ষিহীন স্থান তো খোজে না, মানুষহীন স্থান খুঁজে বেড়ায় কেন ? তার কারণ এই যে, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পূৰ্ণ ঐক্য নেই। বিশ্বপ্রবাহের সঙ্গে মানুষ একটানে একতালে চলে না । এইজনেই যেখানেই মানুষ থাকে সেইখানেই চারি দিকে সে নিজের একটা তরঙ্গ তোলে ; সে একটিমাত্র কথা না বললেও, তারার মতো নিঃশব্দ ও একটুমাত্র নড়াচড়া না কবলেও বনস্পতির মতো নিস্তব্ধ থাকে না । তার অস্তিত্বই অগ্রসর হয়ে আঘাত করে | ভগবান ইচ্ছা করেই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সামঞ্জস্য একটুখানি নষ্ট করে দিয়েছেন— এই তীর আনন্দের কৌতুক । ঐ যে আমাদের পঞ্চভূতের মধ্যে একটু বুদ্ধির সঞ্চার করেছেন, একটা অহংকার যোজনা করে বসে আছেন, তাতে করেই আমরা বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে গেছি— ঐ জিনিসটার দ্বারাতেই আমাদের পঙক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এইজন্যেই গ্রহসূৰ্যতারার সঙ্গে আমরা আর মিল রক্ষা করে চলতে পারি নে- আমরা যেখানে আছি সেখানে যে আমরা আছি, এ কথাটা আর কারও ভোলবার জো থাকে না । ভগবান আমাদের সেই সামঞ্জস্যটি নষ্ট করে প্রকৃতির কাছ থেকে আমাদের একঘরে করে দেওয়াতে সকালবেলা থেকে রাত্রি পর্যন্ত আমাদের নিজের কাজের ধােন্দায় নিজে ঘুরে বেড়াতে হয় | ঐ সামঞ্জস্যটি ভেঙে গেছে বলেই আমাদের প্রকৃতির মধ্যে বিরাট বিশ্বের শান্তি নেই— আমাদের ভিতরকার নানা মহল থেকে রব উঠেছে, চাই চাই চাই। শরীর বলছে চাই, মন বলছে চাই, হৃদয় বলছে চাই- এক মুহুৰ্তও এই রবের বিশ্রাম নেই। যদি সমস্তর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন মিল থাকত তা হলে