পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○ じ রবীন্দ্র-রচনাবলী যে কেৱলমাত্র আমার অনুগ্রহকর্তা নন, তিনি যে আমার আত্মীয় সেটা আমি বুঝি এবং প্রমাণ কৰি । কিন্তু এইটে বুঝতে এবং প্রচার করতে গিয়ে অনেক সময় শেষে দুঃখ পেতে হয়। পরদিনেৰ ছড়ানো ৬াচ্ছিষ্ট, গলা বাতি এবং শুকনো মালার দিকে তাকিয়ে মন উদাস হয়ে যায়— তখন আর চিত্তের রাজকীয় ঔদার্য থাকে না- হিসাবের কথাটা মনে পড়ে মন ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে । কিন্তু দুঃখ পেতে হয় না। তাকে যে প্রতিদিনই কিছু কিছু সম্বল জমিয়ে তোলে— প্রতিদিনই যে লোক উৎসবের আয়ােজন করে চলেছে— যার উৎসবদিনের সঙ্গে প্রতিদিনের সম্পূর্ণ পার্থক্য নেই। পরস্পর নাড়ীর যোগ আছে। এটি না হলেই আমাদের ঋণ করে উৎসব করতে হয় | আনন্দ করি বটে। কিন্তু সে আনন্দের অধিকাংশই ঠিক নিজের কড়ি দিয়ে করি নে— তার পনেরো-আনাই ধারে চালাই | লোক-সমাগম থেকে ধার করি, ফুলের মালা থেকে, আলো থেকে, সভাসজা থেকে ধার করি— গান থেকে, বাজনা থেকে, বক্তৃতা থেকে ধার নিই! সেদিনকার উত্তেজনায় চেতনাই থাকে না যে, ধারে চালাচ্ছিপরদিনে যখন ফুল শুকোয়, আলো নেবে, লোক চলে যায় তখন দেনার প্রকাণ্ড শূন্যতাটা চোখে পড়ে হৃদয়কে ব্যাকুল করে । আমাদের এই দৈন্যবশতই উৎসব দেবতাকে আমরা উৎসবের সঙ্গে সঙ্গেই বিসর্জন দিয়ে বর্সি– উৎসবের অধিপতিকে প্রতিদিনের সিংহাসনে বসাবার কোনো আয়োজন করি নে । আমাদের সৌভাগ্য এই যে আমরা কয়জন প্রতিদিন প্রত্যুষে এই মন্দির-প্রাঙ্গণে একত্রে মিলে কিছু কিছু জমাচ্ছিলুম— আমরা উৎসবের মেলায় একেবারেই রবাহুত বিদেশীর মতো জুটি নি— আমাদের প্রতিদিনের সকালবেলায় সব-কটিই হাতে হাতেই বাজে খরচ হয়ে যায় নি । আমার উৎসবকর্তাকে বোধ করি বলতে পেরেছি যে, তোমার সঙ্গে আমার কিছু পরিচয় আছে, তোমার নিমন্ত্রণ আমি পেয়েছি । তার পরে আমাদের উৎসবকে, হঠাৎ একদিনেই সাঙ্গ করে দেব না— এই উৎসবকে আমাদের দৈনিক উৎসবের মধ্যে প্রবাহিত করে দেব | প্ৰতিদিন প্ৰাতঃকালেই আমাদের দশজনের এই উৎসব চলতে থাকবে । আমাদের প্রতিদিনের সমস্ত তুচ্ছতা এবং আত্মবিস্মৃতির মধ্যে অন্তত একবার করে দিনারম্ভে জগতের নিত্য উৎসবের ঐশ্বর্যকে উপলব্ধি করে যাব । যখন প্রত্যহই উষা তার আলোকটি হাতে করে পূর্ব দিকের প্রান্তে এসে দাড়াবেন তখন আমরা কয়জনেই স্তব্ধ হয়ে বসে অনুভব করব, আমাদের প্রত্যেক দিনই মহিমান্বিত, ঐশ্বৰ্যময়- আমাদের জীবনের তুচ্ছতা তাকে লেশমাত্র মলিন করে নি— প্রতিদিনই সে নবীন, সে উজ্জ্বল, সে পরমাশ্চর্য— তার হাতের অমৃতপাত্র একেবারে উপুড় করে ঢেলেও তার এক বিন্দু ক্ষয় হয় না । حا ৯। পোষ সঞ্চয়তৃষ্ণা একদিনের প্রয়োজনের বেশি যিনি সঞ্চয় করেন না, আমাদের প্রাচীন সংহিতায় সেই দ্বিজ গৃহীকেই প্রশংসা করেছেন। কেননা একবার সঞ্চয় করতে আরম্ভ করলে ক্রমে আমরা সঞ্চায়ের কল হয়ে উঠি, তখন আমাদের সঞ্চয় প্রয়োজনকেই বহুদূরে ছাড়িয়ে চলে যায়, এমন-কি, প্রয়োজনকেই বঞ্চিত ও পীড়িত করতে থাকে । − আধ্যাত্মিক সঞ্চয় সম্বন্ধেও যে এ কথা খাটে না, তা নয়। আমরা যদি কোনো পুণ্যকে মনে করি থে ভবিষ্যৎ কোনো একটা ফললাভের জন্যে তাকে জমাচ্ছি, তা হলে জমানোটাই আমাদের পেয়ে বসেতার সম্বন্ধে আমরা কৃপণের মতো হয়ে উঠি— তার সম্বন্ধে আমাদের স্বাভাবিকতা একেবারে চলে যায় ; সব কথাতেই কেবল আমরা সুদের দিকে তাকাই, লাভের হিসাব করতে থাকি ।