পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ じs রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্মিলিত হয়ে মানবাত্মার উপযুক্ত বিহারক্ষেত্র নির্মাণ করছে না— আমাদের আত্মা কোনােমতেই সেই বিশ্বকর্ম বিরাট পুরুষের সঙ্গে যুক্ত হবার যোগ্য নিজের বিরাট রূপ ধারণ করতে পারছে না। ১৩ পৌষ রাত্রি গতকল্য রাত্রি এবং দিন, নিদ্রা এবং জাগরণের একটি কথা বলা হয় নি । সেটাই হচ্ছে প্রধান কথা । যখন আমরা জাগ্রত থাকি তখন আমাদের শক্তির সঙ্গে শক্তির লীলা ঘটে। বিশ্বকর্মর বিশ্বকর্মের সঙ্গে আমাদের কর্মের যোগসাধন হয় । যিনি “বহুধাশক্তিযোগাং বৰ্ণাননেকান্নিহিতার্থোদধতি"- গতিসকল আবিষ্কার করে আনন্দিত হই। এক সময়ে যেখানে মনে করেছিলুম শক্তির শেষ, চলতে গিয়ে দেখতে পাই সেখান থেকে পথ আবার একটা নূতন বঁােক নিয়েছে ; এমনি করে জগদব্যাপারের সেই বহুধাশক্তির মধ্যে নিজের শক্তিকেও বহুধা করে দিয়ে তার সঙ্গে সকল দিকে সমান গতিলাভ করবার জন্যে আমাদের চিত্ত উৎসাহিত হয়ে ওঠে । এমনি করে আমাদের জাগ্ৰত চৈতন্য সমস্ত ইন্দ্ৰিয়াশক্তি ও মানসশক্তির জলকে চতুর্দিকে নিক্ষেপ করে নানা বেগ নানা স্পর্শ, নানা লাভের দ্বারা নিজেকে সার্থক করে । কিন্তু কেবলই জাল বাইচ করে তো জেলের চলে না । জলে গ্রন্থি পড়ে, জাল ছিড়ে আসে, জাল মলিন হয় । তখন আবার সেগুলো সংশোধন করে নেবার জন্যে জাল-বাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিতে হয় | রাত্রে নিদ্রার সময় আমরা প্ৰাণের জাল-বাওয়া, চেতনার জাল-বাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিই । তখন সংশোধন ও ক্ষতি-পূরণের সময়। তখন আমাদের ছিন্নভিন্ন গ্রস্থিল মলিন জালটিকে তার হাতে সমর্পণ করে দিতে হয় “য এষ সুপ্তেষু জাগর্তি কামং কামং পুরুষো নির্মিমাণঃ” যে পুরুষ, সকলে যখন সুপ্ত তখন জাগ্রত থেকে, প্রয়োজনসকলকে নির্মাণ করছেন। অতএব একবার করে নিজের সমস্ত চেষ্টাকে সংবরণ করে সম্পূর্ণভাবে সেই বিশ্বপ্রাণের হাতে আমাদের প্রাণকে সমর্পণ করে দিতে হয়— সেই সময়ে আমরা গাছপালার সমান হয়ে যাই, প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের কোনো বিচ্ছেদ থাকে না, আমাদের অহংকারের একেবারে নিবৃত্তি হয়, তখনই আমরা নিখিলের অন্তর্বর্তী যে গভীর আরাম তাকেই লাভ করি। জেগে উঠে বুঝতে পারি যে, বিশ্রামকে আমরা এতক্ষণ কেবলমাত্র শূন্যতারূপে পাই নি, তা একটা পূর্ণ বস্তু, আমাদের নিশ্চেষ্টতা নিশ্চৈতনের মধ্যেও সে একটা আরাম— সেটা হচ্ছে বিশাল বিশ্বপ্রকৃতির মূলগত আরাম— যে আরামের শামল মূর্তি ও নির্বক প্রকাশ আমরা শাখাপল্লবিত নিস্তব্ধ বনস্পতির মধ্যে দেখতে পাই। এই যেমন আমাদের প্রাণকে প্রতি রাত্রে প্রকৃতির হাতে সমর্পণ করে দিয়ে আমরা প্ৰভাতে নূতন প্রাণচেষ্টার জন্যে পুনরায় প্রস্তুত হয়ে উঠি— তেমনি দিনের মধ্যে অন্তত একবার করে আমাদের আত্মকে পরমাত্মার হাতে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করে দেবার প্রয়ােজন আছে— নইলে আবর্জনা জমে ওঠে, ভাঙাচােরাগুলো সারে না, তাপ বাড়তেই থাকে- কাম ক্রোপ্ন লোভ প্রভৃতি প্রবৃত্তিগুলো তাদের প্রয়ােজনকে অতিক্রম করে অন্তরে বাহিরে বিদ্রোহ রচনা করে। সেইজন্যে প্রভাতে উপাসনার সময়ে আমাদের সকল চেষ্টাকে ক্ষান্ত করে সব রিপুকে শাস্ত করে কিছুকালের জন্যে পরমাত্মার সঙ্গে আমাদের আপনার পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য স্থাপন করে নেওয়া দরকারসেই সময়ে আমাদের অন্তরের মধ্যে পরমাত্মাকে সম্পূর্ণ পথ ছেড়ে দিতে হবে ; তা হলে সেই একান্ত আত্মবিসর্জনের সুগভীর শান্তির সুযোগে আমাদের মনের ব্যাধির মধ্যে স্বাস্থের সঞ্চার হবে, সমস্ত