পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন ৫৬৩ সংকোচন প্রসারিত হয়ে যাবে এবং হৃদয়গ্ৰন্থিগুলি শিথিল হয়ে আসবে। তার পরে উপাসনাশান্ত সেই আমাদের অন্তরপ্রকৃতি যখন সংসারে বিচিত্রের মধ্যে বহুর মধ্যে বিভক্ত হয়ে ব্যাপ্ত হয়ে নানা আকারে প্রকারে আত্মোপলব্ধিতে প্রবৃত্ত হবে তখন সকল কাজে সে গভীরভাবে পবিত্রভাবে নিযুক্ত হতে পারবে, তখন কথায় কথায় চতুর্দিককে সে আঘাত দিতে থাকবে না, তখন তার সমস্ত চেষ্টার মধ্যে শান্তি থাকবে। বিশাল বিশ্বের বিচিত্র ব্যাপারের মধ্যে যেমন একটি আশ্চর্য সামঞ্জস্য আছে, যেটি থাকতে সমস্ত চেষ্টার মূর্তি শান্ত ও শক্তির মূর্তি সুন্দর হয়ে উঠেছে— যেটি থাকতে বিশ্বজগৎ একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাশালা অথবা প্ৰকাণ্ড কারখানাঘরের মতো কঠোর আকার ধারণ করে নি— আমাদের চেষ্টার মধ্যে সেই সামঞ্জস্য থাকবে, আমাদের কর্মের মধ্যে সেই সৌন্দৰ্য ফুটে উঠবে ! ঈশ্বর যেমন করে কাজ করেন, কিছুক্ষণ তার কাছে আমাদের সমস্ত অহংকারটি নিবৃত্ত করে দিয়ে তার সেই পরম সুন্দর কৌশলটি শিখে নেব । আপনাকে তার চরণ-প্ৰান্তে উপস্থিত করে দিয়ে বলব, জননী, প্রাতঃকালে এর উপরে তোমার নিপুণ হস্তটি একবার স্পর্শ করে দাও— তা হলে গতকল্যকার সংসারের আঘাতে এর উপরে যে-সকল ছিন্নতা এসেছে তা সমস্তই সেরে যাবে । আমরা যদি প্রতিদিন দিবসারম্ভে তার পবিত্র হস্তের স্পর্শ ললাটে গ্রহণ করে নিয়ে যাই এবং সে কথা যদি স্মরণ রাখি। তবে ললাটকে আর ধূলিতে লুষ্ঠিত করতে পারব না । এই উপাসনার সুরটি যেন তানপুরার সুরের মতো আমাদের মধ্যে সমস্তদিন নিয়তই বাজতে থাকে- যাতে আমাদের প্রত্যেক কথাটি এবং ব্যবহারটিকে সেই সুরের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বিচার করতে পারি এবং সমস্ত দিনকে বিশুদ্ধ সংগীতে পরিণত করে সংসারের কর্মক্ষেত্ৰকে আনন্দক্ষেত্র করে তুলতে পারি। ১৪ পৌষ প্ৰভাতে প্রভাতের এই পবিত্র প্রশান্ত মুহূর্তে নিজের আত্মাকে পরমাত্মার মধ্যে একবার সম্পূর্ণ সমাবৃত করে দেখাে, সমস্ত ব্যবধান দূর হয়ে যাক । নিমগ্ন হয়ে যাই, নিবিষ্ট হয়ে যাই, তিনি নিবিড়ভাবে আমাদের আত্মাকে গ্ৰহণ করেছেন এই উপলব্ধি দ্বারা একান্ত পরিপূর্ণ হয়ে উঠি । নইলে আমাদের আপনার সতী পরিচয় হয় না । ভূমীর সঙ্গে যোগযুক্ত করে না দেখলে নিজেকে ক্ষুদ্র বলে ভ্রম হয়, নিজেকে দুর্বল বলে মিথ্যা ধারণা হয় । আমি যে কিছুমাত্র ক্ষুদ্র নই, অশক্ত নই, মানবসমাজে মহাপুরুষেরা তার প্রমাণ দিয়েছেন- তাদের যে সিদ্ধি সে আমাদের প্রত্যেকের সিদ্ধি— আমাদের প্রত্যেক আত্মার শক্তি তাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ হয়েছে। বাতির উধ্বভােগ যখন আলোকশিখা লাভ করেছে তখন সে লাভ সমস্ত বাতির । বাতির নিতান্ত নিন্ন ভাগেও সেই জুলবাের ক্ষমতা রয়েছে— যখন সময় হবে সেও জ্বলবে- যখন সময় না হবে তখন সে উপরের জ্বলন্ত অংশকে ধারণ করে থাকবে । প্রতিদিন প্ৰভাতের উপাসনায় নিজের ভিতরকার মানবাত্মার সেই মাহাত্ম্যকে আমরা যেন একেবারে বাধামুক্ত করে দেখে নিতে পারি। নিজেকে দীন দরিদ্র বলে আমাদের যে ভ্ৰম আছে সেই ভ্রম যেন দূর করে যেতে পারি। আমরা যে কেবল ঘরের কোণে জুম্মলাভ করেছি বলে একটা সংস্কার নিয়ে বসে আছি সেটা যেন ত্যাগ করে স্পষ্ট অনুভব করি ভুর্ভূবঃ স্বর্লোকে আমার এই শরীরের জন্ম, সেইজন্যে বহুলক্ষ যোজন দূর পথ হতে আমাদের জ্যোতিষ্ক কুটুম্বগণ আমাদের তত্ত্ব নেবার জন্যে আলোকের দৃত পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আর আমার অহংকারটুকুর মধ্যেই যে আমার আত্মার চরম আবাস তা নয়— যে অধ্যাত্মলোকে তার স্থিতি সে হচ্ছে ব্ৰহ্মলোক ! যে জগৎসভায় আমরা এসেছি। এখানে রাজত্ব করবার আমাদের অধিকার, এখানে আমরা দাসত্ব করতে আসি নি'। যিনি ভূমা তিনি স্বয়ং আমাদের ললাটে রাজটিকা পরিয়ে পাঠিয়েছেন। অতএব আমরা যেন নিজেকে অকুলীন বলে মাথা