পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ じや রবীন্দ্র-রচনাবলী একটা পৃথিবী যদি থাকত। তবে তিনি জয়যাত্রায় বেরোতেন । দুবেলা যার অন্ন জোটে না সেও কুবেকের ভাণ্ডারের স্বপ্ন দেখে | মানুষের আকাঙক্ষা যে কোনো কল্পনাকেই অসম্ভব বলে মানে না। এমন প্রমাণ অনেক আছে । মানুষ জগদীশ্বরের সঙ্গে প্রেম করতে চায় এও কি তার সেই অত্যাকাঙক্ষারই একটা চরম উন্মত্ততা ? তার অহংকারেরই একটা অশান্ত পরিচয় ? কিন্তু এর মধ্যে তো অহংকারের লক্ষণ নেই। তার প্রেমের জন্যে যে লোক খেপেছে— সে যে নিজেকে দীন করে- সকলের পিছনে সে যে দাড়ায় এবং যারা ঈশ্বরের প্রেমের দরবারের দরবারি তাদের পায়ের ধুলো পেলেও সে যে বঁাচে । কোনো ক্ষমতা কোনো ঐশ্বর্যের কাঙাল সে নয়- সমস্তই সে যে ত্যাগ করবার জন্যেই প্ৰস্তুত হয়েছে । সেইজন্যেই জগৎ সৃষ্টির মধ্যে এইটেই সকলের চেয়ে আশ্চর্য বলে আমার মনে হয় যে, মানুষ তার প্রেম চায়— এবং সকল (প্রমের চেয়ে সেইটোকেই বড়ো সত্য, বড়ো লাভ বলে চায় । কোন চায় ? কেননা মানুষ যে অধিকার পেয়েছে । এই প্রেমের দাবি যিনি জন্মিয়ে দিয়েছেন তারই সঙ্গে যে প্রেম এতে আর ভয় লজা কিসেৱ । তিনি যে আমাকে একটি বিশেষ আমি করে তুলে সমস্ত জগৎ থেকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছেন এইখনেই যে আমার সকলের চেয়ে বড়ো দাবি- সমস্ত সূর্য চন্দ্র তারার চেয়ে বড়ো দাবি । সর্বত্র বিশ্বের ভারাকর্ষণের টান আছে, আমার এই স্বাতন্ত্রটুিকুর উপর তার কোনো টান নেই। যদি থাকত, তা হলে সে যে একে ধূলিরাশির সঙ্গে মিশিয়ে এক করে দিত । প্ৰকাণ্ড জগতের চাপ এই আমিটুকুর উপর নেই বলেই এই আমিটি নিজের গৌরব রক্ষা করে কেমন মাথা তুলে চলেছে । পুরাণে বলে কাশী সমস্ত পৃথিবীর বাইরে । বস্তুত আমিই সেই কাশী । আমি জগতের মাঝখান থেকে সমস্ত জগতের বাইরে । সেইজন্যেই জগতের সঙ্গে নিজেকে ওজন করে ক্ষুদ্র বললে তো চলবে না । তার সঙ্গে আমি তো তুলনীয় নাই । আমি যে একজন বিশেষ আমি । আমাতে তার শাসন নেই, আমাতে তার বিশেষ আনন্দ । সেই আনন্দের উপরেই আমি আছি, বিশ্বনিয়মের উপরে নেই, এইজন্যেই এই আমির ব্যাপারটি একেবারে সৃষ্টিছাড়া । এইজন্যেই এই পরমাশ্চর্য আমির দিকেই তাকিয়ে উপনিষৎ বলে গিয়েছেন “দ্বা সুপর্ণ সাযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজতে ।” বলেছেন, এই আমি আর তিনি, সমান বৃক্ষের ডালে দুই পাখির মতো, দুই সখা একেবারে পাশাপাশি বসে আছেন। তার জগতের রাজ্যে আমাকে খাজনা দিতে হয় ; এই জলস্থল আকাশ-বাতাসের অনেক রকমের ট্যাকস আছে সমস্তই আমাকে কড়ায় গণ্ডায় চুকিয়ে দিতে হয়— যেখানে কিছু দেন পড়ে সেইখনেই প্ৰাণ বেরিয়ে যায়। কিন্তু আমার এই আমিটুকু একেবারে লাখেরাজ, ঐখানেই বন্ধুর মন্দির কিনা, আমার সঙ্গে তার কথা এই যে, তুমি ইচ্ছা করে আমাকে যা দেবে তাই নেব— যদি না দাও। তবু আমার যা দেবার তার থেকে বঞ্চিত করব না । এমন যদি না হত। তবে তীর জগৎরাজ্যের একলা রাজা হয়ে তীরে আনন্দ কী হত । কোথাও যার কোনো সমান নেই তিনি কী ভয়ংকর একলা, কী অনন্ত একলা । তিনি ইচ্ছা করে কেবল প্রেমের জোরে এই একাধিপত্য এক জায়গায় পরিত্যাগ করেছেন। তিনি আমার এই আমিটুকুর কুঞ্জবনে বিশেষ করে নেমে এসেছেন— বন্ধু হয়ে আপনি ধরা দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, “আমার চন্দ্ৰ সূর্যের সঙ্গে তোমার নিজের দামের হিসাব করতে হবে না । কেননা ওজন দরে তোমার দাম নয় | তোমার দাম আমার আনন্দের মধ্যে— তোমার সঙ্গেই আমার বিশেষ প্রেম বলেই তুমি তুমি হয়েছ ।" এইখনেই আমার এত গৌরব যে, তাকে সুদ্ধ আমি অস্বীকার করতে পারি। বলতে পারি। আমি তোমাকে চাই নে। সে কথা তার ধূলি জলকে বলতে গেলে তারা সহ্য করে না, তারা তখনই আমাকে মারতে আসে। কিন্তু তাকে যখন বলি, তোমাকে আমি চাই নে, আমি টাকা চাই, খ্যাতি চাই— তিনি