পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (e. と S. অনন্ত ব্ৰহ্মাণ্ডের ঈশ্বর আমার সেই ইচ্ছােটুকুর জন্যে প্রতিদিন যে আমার দ্বারে আসছেন। আর যাচ্ছেন তার নানা নিদর্শন আছে। এইখানে তিনি তার ঐশ্বর্য খর্ব করেছেন, কেননা এখানেই তার প্রেমের লীলা । এইখানে নেমে এসেই তীর প্রেমের সম্পদ প্রকাশ করেছেন— আমারও ইচ্ছার কাছে তার ইচ্ছাকে সংগত করে তার অনন্ত ইচ্ছাকে প্রকাশ করেছেন— কেননা ইচ্ছার কাছে ছাড়া, ইচ্ছার চরম প্রকাশ হবে কোথায় ? তিনি বলছেন, রাজখাজনা নয়, আমাকে প্রেম দাও । তােমাকে প্রেম দিতে হবে বলেই তো তুমি এত কাণ্ড করেছ। আমার মধ্যে এই এক অদ্ভুত আমির লীলা ফেদে বসেছ- এবং আমাকে এই একটি ইচ্ছার সম্পদ দিয়ে সেটি পাবার জনো আমার কাছেও হাত পেতে দাড়িয়েছ । ১৮ পৌষ সৌন্দর্য ঈশ্বর সত্যং। তার সত্যকে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য। সত্যকে এতটুকুমাত্র স্বীকার না করলে আমাদের নিস্কৃতি নেই। সুতরাং অমোঘ সত্যকে আমরা জলে স্থলে আকাশে সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তিনি তো শুধু সত্য নন— তিনি “আনন্দ রূপমমৃতং" । তিনি আনন্দরূপ, অমৃতরূপ । সেই আমি পূর্বেই আভাস দিয়েছি আনন্দ স্বভাবতই মুক্ত । তার উপরে জোর খাটে না, হিসাব চলে না । এই কারণে আমরা যেদিন আনন্দের উৎসব করি সেদিন প্রতিদিনের বাধা নিয়মকে শিথিল করে দিই— সেদিন স্বার্থকে শিথিল করি, প্রয়োজনকে শিথিল করি, আত্মপরের ভেদকে শিথিল করি, সংসারের কঠিন সংকোচকে শিথিল করি— তবেই ঘরের মাঝখানে এমন একটুখানি ফাঁকা জায়গা তৈরি হয় যেখানে আনন্দের প্রকাশ সম্ভবপর | সত্য বাধনকেই মানে, আনন্দ বাধন মানে না । এইজন্য বিশ্বপ্রকৃতিতে সত্যের মূর্তি দেখতে পাই নিয়মে, এবং আনন্দের মূর্তি দেখি সৌন্দর্যে । এইজন্য সত্যরূপের পরিচয় আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক, আনন্দরূপের পরিচয় আমাদের না হলেও চলে। প্রভাতে সূর্যোদয়ে আলো হয়, এই কথাটা জানা এবং এটাকে ব্যবহারে লাগানো আমাদের নিতান্ত দরকার ; কিন্তু প্ৰভাত যে সুন্দর সুপ্ৰশান্ত, এটুকু না জানলে আমাদের কোনো কাজের কোনো ক্ষতিই হয় না । জল স্থল আকাশ আমাদের নানা বন্ধনে বদ্ধ করছে কিন্তু এই জল স্থল আকাশে নানা বর্ণে গন্ধে গীতে সৌন্দর্যের যে বিপুল বিচিত্র আয়োজন সে আমাদের কিছুতে বাধ্য করে না, তার দিকে না। তাকিয়ে চলে গেলে সে আমাদের অরসিক বলে গালিও দেয় না | অতএব দেখতে পাচ্ছি, জগতের সত্যলোকে আমরা বদ্ধ, সৌন্দর্যলোকে আমরা স্বাধীন। সত্যকে যুক্তির দ্বারা অখণ্ডনীয়রূপে প্রমাণ করতে পারি, সৌন্দর্যকে আমাদের স্বাধীন আনন্দ ছাড়া আর কিছুর দ্বারাই প্রমাণ করবার জো নেই। যে ব্যক্তি তুড়ি দিয়ে বলে “ছাই তোমার সৌন্দৰ্য” মহাবিশ্বের লক্ষ্মীকেও তার কাছে একেবারে চুপ করে যেতে হয় । কোনো আইন নেই, কোনো পেয়াদ নেই যার দ্বারা এই সৌন্দর্যকে সে দায়ে পড়ে মেনে নিতে পারে । অতএব জগতে ঈশ্বরের এই যে অপরূপ রহস্যময় সৌন্দর্যের আয়োজন, এ আমাদের কাছে কোনো মাসুল কোনো খাজনা আদায় করে না, এ আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে চায়— বলে, আমাতে তোমার আনন্দ হােক ; তুমি স্বত আমাকে গ্রহণ করে । আনন্দময়ের যে যাতায়াত আছে, জগৎ জুড়ে তার নিদর্শন পড়ে রয়েছে । আকাশের নীলিমায়, বনের