পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন 々a> তিনিই হচ্ছেন রস— তিনিই আনন্দ | পূর্বেই আভাস দিয়েছি, আমরা শক্তির দ্বারা প্রয়োজন সাধন করতে পারি, যুক্তির দ্বারা জ্ঞান লাভ করতে পারি। কিন্তু আনন্দের সম্বন্ধে শক্তি এবং যুক্তি কেবল দ্বার পর্যন্ত এসে ঠেকে যায়— তাদের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই আনন্দের সঙ্গে একেবারে অন্তঃপুরের সম্বন্ধ হচ্ছে ইচ্ছার । আনন্দে কোনোরকম জোর খাটে না— সেখানে কেবল ইচ্ছা, কেবল খুশি । আমার মধ্যে এই ইচ্ছার নিকেতন হচ্ছে হৃদয় । আমার সেই ইচ্ছাময় হৃদয় কি শূন্যে প্রতিষ্ঠিত ! তার পুষ্টি হচ্ছে মিথ্যায়, তার গম্য স্থান হচ্ছে ব্যর্থতার মধ্যে ? তবে এই অদ্ভুত উপসর্গটা এল কোথা থেকে, এক মুহূর্ত আছে কোন উপায়ে । জগতের মধ্যে কি কেবল একটি মাত্ৰই ফাকি আছে । এবং সেই ফাঁকিটিই আমার এই হৃদয় ? কখনােই নয়। আমাদের এই ইচ্ছা-রসময় হৃদয়টি জগদব্যাপী ইচ্ছারসের নাড়ির সঙ্গে বাধা— । সেইখান থেকেই সে আনন্দরস পেয়ে বেঁচে আছে— না পেলে তার প্রাণ বেরিয়ে যায়— সে অন্নবস্তু চায় না, বিদ্যাসাধ্য চায় না, অমৃত চায়, প্রেম চায় । যা চায় তা ক্ষুদ্ররূপে সংসারে এবং চরমরূপে তাতে আছে বলেই চায়— নইলে কেবল রুদ্ধদ্বারে মাথা-খুঁড়ে মরবার জন্যে তার সৃষ্টি হয় নি । অতএব হৃদয় আপনাকে জানে বলেই নিশ্চয় জানে তার একটি পরিপূর্ণ কৃতাৰ্থতা অনন্তের মধ্যে আছে । ইচ্ছা কেবল তার দিকেই আছে তা নয়, অন্যদিকেও আছে- অন্যদিকে না থাকলে সে নিমেষকালও থাকত না- এতটুকু কণামাত্রও থাকত না যাতে নিশ্বাসপ্রশ্বাসরূপ প্রাণের ক্রিয়াটুকুও চলতে পারে । সেইজন্যেই উপনিষৎ এত জোর করে বলেছেন, “কোহ্যেবান্যাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ যাদোষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ, এস হ্যেবানন্দয়াতি” কেই বা শরীরের চেষ্টা করত, কেই বা প্ৰাণধারণ করত, যদি আকাশে এই আনন্দ না থাকতেন— ইনিই আনন্দ দেন । ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার মাঝখানে দীেত্যসাধন করে প্রার্থনা | দুই ইচ্ছার মাঝখানে যে বিচ্ছেদ আছে সেই বিচ্ছেদের উপরে ব্যাকুলবেশে দাঁড়িয়ে আছে ঐ প্রার্থনা-দূতী ৷ এইজনো অসাধারণ সাহসের সঙ্গে বৈষ্ণব বলেছেন যে, জগতের বিচিত্র সৌন্দর্যে ভগবানের বঁাশির যে নানা সুর বেজে উঠছে সে কেবল আমাদের জন্যে তার প্রার্থনা— আমাদের হৃদয়কে তিনি এই অনির্বচনীয় সংগীতে ডাক দিয়ে চাচ্ছেন, সেইজন্যেই তো এই সৌন্দৰ্য্য-সংগীত আমাদের হৃদয়ের বিরহবেদনাকে জাগিয়ে তোলে | সেই ইচ্ছাময় এমনি মধুরস্বরে যেখানে আমাদের ইচ্ছাকে চাচ্ছেন, সেখানে তার সমস্ত জোরকে একেবারে সংবরণ করেছেন- যে প্রচণ্ড জোরে তিনি সৌরজগৎকে সূর্যের সঙ্গে অমোঘরূপে বেঁধে দিয়েছেন সেই জোরের লেশমাত্র এখানে নেই।-- সেইজন্যে এমন করুণ, এমন মধুর সুরে এমন নানা বিচিত্র রসে বঁাশি বাজছে— আহবানের আর অন্ত নেই । তীরে এমন আহবানে আমাদেরও মনের প্রার্থনা কি জাগবে না ? সে কি তার বিরহের ধূলি-আসনে লুটিয়ে কেঁদে উঠবে না ? অসত্য অন্ধকার এবং মৃত্যুর নিরানন্দ নির্বািসন থেকে অভিসার ঘাঞার সময়ে এই প্রার্থনাদৃতীই কি তার কম্পিত দীপশিখাটি নিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে চলবে না ? যতদিন আমাদের হৃদয়ে আছে, যতদিন প্রেমস্বরূপ ভগবান তার নানা সৌন্দর্য দ্বারা এই জগৎকে আনন্দনিকেতন করে সাজাচ্ছেন, ততদিন তার সঙ্গে মিলন না হলে মানুষের বেদনা ঘুচাবে কী করে ? ততদিন কোন সন্দেহকঠোর জ্ঞানাভিমান মানুষের প্রার্থনাকে অপমানিত করে ফিরিযে দিতে পারে। এই আমাদের প্রার্থনাটি যে বিশ্বমানবের অন্তরের পঙ্কশয্যা থেকে ব্যাকুল শতদলের মতো তার সমস্ত জলরাশির আবরণ ঠেলে আলোকের অভিমুখে মুখ তুলছে- তার সমস্ত সৌগন্ধ্য এবং শিশিরাশ্রুসিক্ত সৌন্দর্য উদঘাটিত করে দিয়ে বলছে- “অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতিৰ্গময়, মৃতোর্মামৃতং গময়।” মানবহৃদয়ের এই পরিপূর্ণ প্রার্থনার পূজোপহারটিকে মােহ বলে তিরস্কৃত করতে পারে এত বড়ো নিদারুণ শুষ্কতা করি আছে ? ২০ পৌষ १||७१