পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ ዓ S রবীন্দ্র-রচনাবলী বিধান এই ইচ্ছা প্ৰেম আনন্দের কথাটা উঠলেই তার উলটাে কথাটা এসে মনের মধ্যে আঘাত করতে থাকে । সে বলে, তবে এত শাসন বন্ধন কেন ? যা চাই তা পাই নে কেন, যা চাই নে তা ঘাড়ে এসে পড়ে ? এইখানে মানুষ তর্কের দ্বারা নয়, কেবলমাত্র বিশ্বাসের দ্বারা এর উত্তর দিতে চেষ্টা করছে । সে বলছে, “স এব বন্ধুর্জনিতা স বিধাতা ।” অর্থাৎ যিনি আমাকে প্রকাশ করেছেন, “স এব বন্ধুঃ” তিনি তো আমার বন্ধ হবেনাই । আমাতে যদি তার আনন্দ না থাকত। তবে তো আমি থাকতুমাই না । আবার “স বিধাতা” । বিধাতা আর দ্বিতীয় কেউ নয়।— যিনি জনিতা তিনিই বন্ধু, বিধানকর্তাও তিনি— অতএব বিধান যাই হােক, মূলে কোনো ভয় (F কিন্তু বিধান জিনিসটা তো খামখেয়ালি হলে চলে না ; আজ একরকম, কাল অন্যরকম--- আমার পক্ষে একরকম, অন্যের পক্ষে অন্যরকম— কখন কী রকম তার কোনো স্থিরতা নেই, এ তো বিধান নয় । বিধান যে বিশ্ববিধান । এই বিধানের অবিচ্ছিন্ন সূত্রে এই পৃথিবীর ধূলি থেকে নক্ষত্ৰলোক পর্যন্ত এক সঙ্গে গাথা রয়েছে : আমার সুখ সুবিধার জন্য যদি বলি, তোমার বিধানের সূত্র এক জায়গায় ছিন্ন করে দাও— এক জায়গায় অন্য সকলের সঙ্গে আমার নিয়মের বিশেষ পার্থক্য করে দাও, তা হলে বস্তুত বলা হয় যে, এই কাদটুিকু পার হতে আমার কাপড়ে দাগ লাগছে। অতএব এই ব্ৰহ্মাণ্ডের মনিহারের ঐক্যসূত্রটিকে ছিড়ে সমস্ত সূৰ্য্যতারাকে রাস্তায় ছড়িয়ে ফেলে দাও । এই বিধান জিনিসটা কারও একলার নয় এবং কোনো একখণ্ড সময়ের নয়--- এই বিশ্ববিধানের যোগেই সমষ্টির সঙ্গে আমরা প্রত্যেকে যুক্ত হয়ে আছি এবং কোনো কালে সে যোগের বিচ্ছেদ নেই ; উপনিষৎ বলেছেন, যিনি বিশ্বের প্রভু, তিনি “যাথাত থাতোহথান বাদধাৎ শাশ্বতী ভয় সমভাঃ” তিনি নিত্যকাল হতে এবং নিতাকালের জন্য সমস্তই যথা তথরাপে বিধান করছেন । এই বিধানের মূলে শাশ্বতকাল— এ বিধান অনাদি অনন্তকালের বিধান ; তার পরে আবার, এই বিধান যাথা তথ্যতঃ বিহিত হচ্ছে— এর আদ্যোপান্তই যথাতথা— কোথাও ছেদ নেই, অসংগতি নেই । আধুনিক বিজ্ঞানশাস্ত্ৰ বিশ্ববিধান সম্বন্ধে এর চেয়ে জোর করে এবং পরিষ্কার করে কিছু বলে নি । কিন্তু শুধু তাই যদি হয়, যদি কেবল অমোঘ নিয়মের লীেহ-সিংহাসনে তিনি কেবল বিধাতারূপেই বসে থাকেন তা হলে তো সেই বিধাতার সামনে আমরা কাঠ-পাথর ধূলি-বালিরই সমান হই । তা হলে তো আমরা শিকলে বাধা বন্দী | কিন্তু তিনি শুধু তো বিধাতা নন, “স এব বন্ধুঃ”— তিনিই যে বন্ধু | বিধাতার প্রকাশ তাে বিশ্বচরাচরে দেখছি, বন্ধুর প্রকাশ কোনখানে ? বন্ধুর প্রকাশ তো নিয়মের ক্ষেত্র নয়— সে প্রকাশ আমার অন্তরের মধ্যে প্রেমের ক্ষেত্রে ছাড়া আর কোথায় হবে ? বিধাতার কর্মক্ষেত্র এই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে— আর বন্ধুর আনন্দনিকেতন আমার জীবাত্মায় । মানুষ একদিকে প্রকৃতি আর-একদিকে আত্মা— একদিকে রাজার খাজনা জোগায় আর-একদিকে বন্ধুর ডালি সাজায় । একদিকে সত্যের সাহায্যে তাকে মঙ্গল পেতে হয়, আর-একদিকে মঙ্গলের ভিতর দিয়ে তাকে সুন্দর হয়ে উঠতে হয় । ঈশ্বরের ইচ্ছা যেদিকে নিয়মরূপে প্রকাশ পায় সেইদিকে প্রকৃতি— আর ঈশ্বরের ইচ্ছা যেদিকে আনন্দরূপে প্রকাশ পায় সেইদিকে আত্মা | এই প্রকৃতির ধর্ম বন্ধন- আর আত্মার ধর্ম মুক্তি । এই সত্য এবং আনন্দ, এই বন্ধন এবং মুক্তি তার বাম এবং দক্ষিণ বাহু। এই দুই বাহু দিয়েই তিনি মানুষকে ধরে রেখেছেন । যেদিকে আমি ইট কাঠ গাছ পাথরের সমান সেই সাধারণ দিকে ঈশ্বরের সর্বব্যাপী নিয়ম