পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ % $ሪ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী প্রকৃতি প্রকৃতি ঈশ্বরের শক্তির ক্ষেত্র, আর জীবাত্মা তার প্রেমের ক্ষেত্র, একথা বলা হয়েছে। প্রকৃতিতে শক্তি দ্বারা তিনি নিজেকে ‘প্রচার করছেন, আর জীবাত্মায় প্রেমের দ্বারা তিনি নিজেকে ‘দান করছেন। অধিকাংশ মানুষ এই দুই দিকে ওজন সমান রেখে চলতে পারে না । কেউ বা প্ৰাকৃতিক দিকেই সাধনা প্রয়োগ করে, কেউ বা আধ্যাত্মিক দিকে । ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যেও এসম্বন্ধে ভিন্নতা প্ৰকাশ প্রকৃতির ক্ষেত্রে যাদের সাধনা তারা শক্তি লাভ করে, তারা ঐশ্বর্যশালী হয়, তারা রাজা সাম্রােঞ্জ। বিস্তার করে । তারা অন্নপূর্ণার বরলাভ করে পরিপুষ্ট হয় । তারা সর্ববিষয়ে বড়ো হয়ে ওঠবার জন্য পরস্পর ঠেলা ঠেলি করতে করতে একটা খুব বড়ো জিনিস লাভ করে । অর্থাৎ তাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তাদের শ্রেষ্ঠ লাভ হচ্ছে ধর্মনীতি । কারণ, বড়ো হয়ে উঠতে গেলে, শক্তিশালী হয়ে উঠতে গেলেই অনেকের সঙ্গে মিলতে হয় । এই মিলন-সাধনের উপরেই শক্তির সার্থকতা নির্ভর করে । কিন্তু বড়ো রকমে, স্থায়ী রকমে, সকলের সেয়ে সার্থক রকমে মিলতে গেলেই এমন একটি নিয়মকে স্বাকার করতে হয় যা মঙ্গলের নিয়ম-- অর্থাৎ বিশ্বের নিয়ম- অর্থাৎ ধর্মনীতি । এই নিয়মকে স্বীকার করলেই সমস্ত বিশ্ব আনুকলা করে—, যেখা", অস্বীকার করা যায়। সেইখানেই সমস্ত বিশ্বের আঘাত লাগতে থাকে- সেই আঘাত লাগতে লাগতে কোন সময়ে যে ছিদ্র দেখা দেয় তা চোখেই পড়ে না— অবশেষে বহুদিনের কীর্তি দেখতে দেখ:ে ভূমিসাৎ হয়ে যায় । যারা শক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে কাজ করেন তাদের বড়ো বড়ো সাধকেরা এই নিয়মকে বিশে? করে আবিষ্কার করেন । তারা জানেন, নিয়মই শক্তির প্রতিষ্ঠাস্থল, তা ঈশ্বরের সম্বন্ধেও যেমন মানু?ে:</ সম্বন্ধেও তেমনি । নিয়মকে যেখালে লঙঘন করব শক্তিকে সেইখানেই নিরাশ্রয় করা হবে । র্যাক আপিসে নিয়ম নেই সে অশক্ত কমী । যার গৃহে নিয়ম নেই সে অশক্ত গৃহী ; যে রাষ্ট্রব্যাপারে নিয়া, লঙঘন হয় সেখানে অশক্ত শাসনতন্ত্র । যার বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপারে নিয়মকে দেখতে পায় না সে জীবনের সর্ব বিষয়েই অশক্ত, অকৃতাৰ্থ, পরাভত । এইজনো যথার্থ শক্তির সাধকেরা নিয়মকে বুদ্ধিতে স্বীকার করেন, বিশ্বে স্বীকার করেন, নিজের কর্মে স্বীকার করেন । এইজনেই তারা যোজনা করতে পারেন, রচনা করতে পারেন, লাভ করতে পারেন । এইরূপে তারা যে পরিমাণে সত্যশালী হন। সেই পরিমাণেই ঐশ্বৰ্য্যশালী হয়ে উঠতে থাকেন। কিন্তু এর-একটি মুশকিল হচ্ছে এই যে, অনেক সময়ে তারা এই ধর্মনীতিকেই মানুষের শেষ স** বলে জ্ঞান করেন । যার সাহায্যে কেবলই কম করা যায়, কেবলই শক্তি, কেবলই উন্নতি লাভ করা যায়, সেইটোকেই তারা চরম শ্রেয় বলে জানেন । এইজনে বৈজ্ঞানিক সত্যকেই তারা চরম সত্য বলে জ্ঞান করেন এবং সকল কর্মের আশ্রয়ভূত ধর্মনীতিকেই তারা পরম পদাৰ্থ বলে অনুভব করেন । কিন্তু যারা শক্তির ক্ষেত্রেই তাদের সমস্ত পাওয়াকে সীমাবদ্ধ করে রাখে তারা ঐশ্বৰ্যকে পk. ঈশ্বরকে পায় না । কারণ ঈশ্বর সেখানে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে নিজের ঐশ্বর্যকে উদঘাটন করেছেন এই অনন্ত ঐশ্বৰ্য্যসমূদ্র পার হয়ে ঈশ্বরে গিয়ে পৌছোবে এমন সাধা করি আছে । ঐশ্বর্যের তো অস্তু নেই, শক্তিরও শেষ নেই | সেইজনো ওপথে ক্রমাগতই অন্তহীন একের থেকে আরের দিকে চলতে হয় | সেইজনোই মানুষ এই রাস্তায় চলতে চলতে বলতে থাকে- ঈশ্বর নেই, কেবলই এই আছে, এবং এই আছে ; আর আছে, এবং আরো আছে । ঈশ্বরের সমান না হতে পারলে তাকে উপলব্ধি করব কী করে ? আমরা যতই রেলগাড়ি চালাই আর টেলিগ্রাফের তার বসাই শক্তিক্ষেত্রে আমরা ঈশ্বর হতে অনন্ত দূরে থেকে যাই । যদি স্পর্ধা করে তীর্ণ সঙ্গে প্ৰতিযোগিতা করবার চেষ্টা করি তা হলে আমাদের চেষ্টা আপন অধিকারকে লঙঘন করে। বাসকাশীর মতো অভিশপ্ত এবং বিশ্বামিত্রের সৃষ্ট জগতের মতো বিনাশপ্ৰাপ্ত হয় ।