পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন O qq এইজন্যেই জগতের সমস্ত ধর্মসাধকেরা বারংবার বলেছেন, ঐশ্বর্যপথের পথিকদের পক্ষে ঈশ্বরদর্শন অত্যন্ত দুঃসাধ্য। অন্তহীন চেষ্টা চরমতাহীন পথে তাদের কেবলই ভুলিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে যায়। অতএব ঈশ্বরকে বাহিরে অর্থাৎ তীর শক্তির ক্ষেত্রে কোনাে জায়গায় আমরা লাভ করতে পারি নে। সেখানে যে বালুকণাটির অন্তরালে তিনি রয়েছেন সেই বালুকণাটিকে নিঃশেষে অতিক্রম করে এমন সাধ্য কোনো বৈজ্ঞানিকের, কোনো যান্ত্রিকের নেই। অতএব শক্তির ক্ষেত্রে যে লোক ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে যায় সে অর্জনের মতো ছদ্মবেশী মহাদেবকে বাণ মারে- সে বাণ তাকে স্পর্শ করে না- সেখানে না হেরে উপায় নেই | এই শক্তির ক্ষেত্রে আমরা ঈশ্বরের দুই মূর্তি দেখতে পাই— এক হচ্ছে অন্নপূর্ণ মূর্তি— এই মূর্তি ঐশ্বর্যের দ্বারা আমাদের শক্তিকে পরিপুষ্ট করে তোলে। আর-এক হচ্ছে করালী কালী মূর্তি— এই মূর্তি আমাদের সীমাবদ্ধ শক্তিকে সংহরণ করে নেয় ; আমাদের কোনো দিক দিয়ে শক্তির চরমতায় যেতে দেয় না— না। টাকায়, না খ্যাতিতে, না অন্য কোনো বাসনার বিষয়ে । বড়ো বড়ো বাজ্যসাম্রাজ্য ধূলিসাৎ হয়ে যায়- বড়ো বড়ো ঐশ্বর্যভাণ্ডার ভূক্তশেষ নারিকেলের খোলার মতো পড়ে থাকে । এখানে পাওয়ার মূর্তি খুব সুন্দর উজ্জ্বল এবং মহিমান্বিত, কিন্তু যাওয়ার মূর্তি, হয় বিষাদে পরিপূর্ণ নয় ভয়ংকর । তা শূন্যতার চেয়ে শূন্যতর, কারণ, তা পূর্ণতার অন্তর্ধন । কিন্তু যেমনই হােক, এখানে পাওয়াও চরম নয়, যাওয়াও চরম নয়— এখানে পাওয়া এবং যাওয়ার আবর্তন কেবলই চলেছে। সুতরাং এই শক্তির ক্ষেত্র মানুষের স্থিতির ক্ষেত্র নয় । এর কোনোখানে এসে মানুষ চিরদিনের মতো বলে না যে, এইখানে পৌছোনো গেল । ২৪ পৌষ 에GI শক্তির ক্ষেত্রে যারা কাজ করে তারা অনন্ত উন্নতির কথা বলে । অর্থাৎ অনন্ত গতির উপরেই তারা জোর দেয়, অনন্ত স্থিতির উপর নয় । তারা অনন্ত চেষ্টার কথাই বলে, অনন্ত লাভের কথা বলে না । এইজনা ধর্মনীতিই তাদের শেষ সম্বল । নীতি কিনা নিয়ে যাবার জিনিস— তা পথের পাথেয় । যারা পথকেই মানে তারা নীতিকেই চরমরূপে মানে— তারা গৃহের সম্বলের কথা চিন্তা করে না । কারণ, যে গহে কোনোকালেই মানুষ পৌঁছবে না, সে গৃহকে মানলেও হয়, না মানলেও হয়। যে উন্নতি অনন্ত উন্নতি, তাকে উন্নতি না বললে ক্ষতি হয় না | শেষ হয়ে গিয়ে নিশ্চেষ্ট তামসিকতায় নিয়ে গিয়ে ফেলে ; বস্তুত ঐশ্বৰ্য-পদার্থের গৌরবই এই যে, সে আমাদের কোনো লাভের মধ্যে এনে ধরে রাখে না, সে আমাদের অগ্রসর করতে থাকে । যতক্ষণ আমাদের শক্তি থাকে ততক্ষণ। ঐশ্বৰ্য আমাদের থামতে দেয় না ; কিন্তু দুৰ্গতির পূর্বে দেখতে পাই মানুষ বলতে থাকে, এইটেই আমি চেয়েছিলুম এবং এইটেই আমি পেয়েছি। তখন পথিকধর্ম সে বিসর্জন দিয়ে সঞ্চয়ীর ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে- তখন সে আর সম্মুখের দিকে তাকায় না, যা পেয়েছে সেইটেকে কী করলে আটেঘাটে বাধা যায়, রক্ষা করা যায়, সেই কথাই সে ভাবতে থাকে ।