পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(brS রবীন্দ্র-রচনাবলী যাই হােক, আনন্দের ধর্ম যদি কর্ম হয় তবে কর্মের দ্বারাই সেই আনন্দস্বরূপ ব্ৰহ্মের সঙ্গে আমাদের যোগ হতে পারে । গীতায় একেই বলে কর্মযোগ । কর্মযোগের একটি লৌকিক রূপ পৃথিবীতে আমরা দেখেছি। সে হচ্ছে পতিব্ৰতা স্ত্রীর সংসারযাত্ৰা । সতী স্ত্রীর সমস্ত সংসারকর্মের মূলে আছে স্বামীর প্রতি প্রেম ; স্বামীর প্রতি আনন্দ | এইজন্য সংসারকর্মকে তিনি স্বামীর কর্ম জেনেই আনন্দ বোধ করেন- কোনো ক্রীতদাসীও তার মতো এমন করে কাজ করতে পারে না । এই কাজ যদি একান্ত তার নিজের প্রয়োজনের কাজ হত, তা হলে এর ভার বহন করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য হত । কিন্তু এই সংসারকর্ম তীর পক্ষে কর্মযোগ | এই কর্মের দ্বারাই তিনি স্বামীর সঙ্গে বিচিত্ৰভাবে মিলিত হচ্ছেন । আমাদের কর্মক্ষেত্র এই কর্মযোগের যদি তপোবন হয় তবে কর্ম আমাদের পক্ষে বন্ধন হয় না । তা দ্বারাই কর্মের সংসারকে উত্তীর্ণ হয়ে— মৃত্যং তীরত্ব- অমৃতকে লাভ করি । এইজন্যই গৃহস্থের প্রতি উপদেশ আছে, তিনি যে যে কাজ করবেন তা নিজেকে যেন নিবেদন না করেন— তা করলেই কর্ম তীকে নাগপাশে বাধবে এবং ঈর্ষাদ্বেষ লোভক্ষোভের বিষনিশ্বাসে তিনি জর্জরিত হতে থাকবেন, তিনি— যদযৎ কর্ম প্রকুবীত তদব্ৰহ্মণি সমৰ্পয়েৎ— যে যে কৰ্ম করবেন। সমস্ত ব্ৰহ্মকে সমর্পণ করবেন । তা হলে, সতী গৃহিণী যেমন সংসারের সমস্ত ভোগের অংশ পরিত্যাগ করেন। অথচ সংসারের সমস্ত ভার অশ্রান্ত যত্নে বহন করেন- কারণ, কর্মকে তিনি স্বার্থসাধনরূপে জানেন না, আনন্দসাধনরপেই জানেন- আমরাও তেমনি কর্মের আসক্তি দূর করে, কর্মের ফলাকাঙক্ষা বিসর্জন করে কর্মকে বিশুদ্ধ আনন্দময় করে তুলতে পারব— এবং যে আনন্দ আকাশে না থাকলে— কেহােবানাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ— কেই বা কিছুমাত্র চেষ্টা করত, কেই বা প্ৰাণ ধারণ করত, কোনোকালেও এবং কাহা হতেও ভয়প্ৰাপ্ত হব না | ২৭ পৌষ শক্তি জ্ঞান প্রেম ও শক্তি এই তিন ধারা যেখানে একত্র সংগত সেইখানেই আনন্দন্তীৰ্থ । আমাদের মধ্যে জ্ঞান প্রেম ও কর্মের যে পরিমাণে পূর্ণ মিলন, সেই পরিমাণেই আমাদের পূর্ণ আনন্দ । বিচ্ছেদ ঘটলেই পীড়া উৎপন্ন হয় | এইজন্যে কোনো একটা সংক্ষেপ উপায়ের প্রলোভনে যেখানে আমরা ফাকি দেব। সেখানে আমরা নিজেকেই ফাকি দেব । যদি মনে করি দ্বারীকে ডিঙিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করব তা হলে দেউড়িতে এমনি আমাদের লাঞ্ছনা হবে যে, রাজদর্শনই দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। যদি মনে করি নিয়মকে বর্জন করে নিয়মের উর্ধের্ব উঠব তা হলে কুপিত নিয়মের হাতে আমাদের দুঃখের একশেষ হবে। বিধানকে সম্পূর্ণ স্বীকার করে তবেই বিধানের মধ্যে আমাদের কর্তৃত্ব জন্মে। গৃহের যে কর্তা হতে চায় গৃহের সমস্ত নিয়ম সংযম তাকেই সকলের চেয়ে বেশি মানতে হয়— সেই স্বীকারের দ্বারাই সেই কর্তৃত্বের অধিকার লাভ করে। এই কারণেই বলছিলুম, সংসারের মধ্যে থেকেই আমরা সংসারের উর্ধের্ব উঠতে পারি— কর্মের মধ্যে থেকেই আমরা কর্মের চেয়ে বড়ো হতে পারি। পরিত্যাগ করে পলায়ন করে কোনোমতেই তা अ&द ठू९] ब्रों | কারণ, আমাদের যে মুক্তি, সে স্বভাবের দ্বারা হলেই সত্য হয়, অভাবের দ্বারা হলে হয় না ।