পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(?述)○ রবীন্দ্র-রচনাবলী নির্বিশেষ সংসার পদার্থটা আলো-আঁধার ভালোমন্দ জন্মমৃত্যু প্রভৃতি দ্বন্দ্বের নিকেতন এ কথা অত্যন্ত পুরাতন | এই দ্বন্দ্বের দ্বারাই সমস্ত খণ্ডিত । আকর্ষণ-শক্তি, বিপ্রকর্ষণশক্তি- কেন্দ্ৰানুগ শক্তি, কেন্দ্রাতিগ শক্তি— কেবলই বিরুদ্ধতা-দ্বারাই সৃষ্টিকে জাগ্রত করে রেখেছে। কিন্তু এই বিরুদ্ধতাই যদি একান্ত সত্য হত তা হলে জগতের মধ্যে আমরা যুদ্ধকেই দেখতুম— শান্তিকে কোথাও কিছুমাত্র দেখতুম না । অথচ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সমস্ত দ্বন্দ্বযুদ্ধের উপরে অখণ্ড শান্তি বিরাজমান। তার কারণ, এই বিরোধ সংসারেই আছে, ব্ৰহ্মে নেই । মনে করি অন্ধকারকে সোজা করে টেনে চললে সে অনন্তকাল অন্ধকারই থাকবে- কারণ, অন্ধকারের একটা বিশিষ্টতা আছে, সেই বিশিষ্টতার কুত্ৰাপি অবসান নেই। তর্কে এই প্রকার সোজা লাইন থাকতে পারে, কিন্তু সত্যে নেই | সত্যে গোল লাইন । অন্ধকারকে টেনে চলতে গেলে ধীরে ধীরে বেঁকে বেঁকে এক জায়গায় সে আলোয় গোল হয়ে ওঠে । সুখকে সোজা লাইনে টানতে গেলে সে দুঃখে এসে বেঁকে দাঁড়ায়— ভ্রমকে ঠেলে চলতে চলতে এক জায়গায় সে সংশোধনের রেখায় আপনি এসে পড়ে । এর একটিমাত্র কারণ- অনন্তের মধ্যে বিরুদ্ধতার পক্ষপাত নেই । অখণ্ড আকাশ-গোলকের মধ্যে পূর্ব দিকের পূর্বত্ব নেই, পশ্চিমের পশ্চিমত্ব নেই– পূর্ব পশ্চিমের মাঝখানে কোনো বিরোধ নেই, এমন-কি, বিচ্ছেদও নেই। পূর্ব পশ্চিমের বিশেষত্ব খণ্ডআমির বিশেষত্বকে আশ্রয় করেই আছে। এই-যে জিনিসটা ব্ৰহ্মের স্বরূপে নেই। অথচ আছে, তাকে কী নাম দেওয়া যেতে পারে ? বেদান্ত তাকে মায়া নাম দিয়েছেন- অর্থাৎ ব্ৰহ্ম যে সত্য, এ সে সত্য নয় । এ মায়া । যখনই ব্ৰহ্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে যাই তখনই একে আর দেখা যায় না । ব্ৰহ্মের দিক থেকে দেখতে গেলেই এ-সমস্ত অখণ্ড গোলকে অনন্তভাবে পরিসমাপ্ত | আমার দিক দিয়ে দেখতে গেলেই বিরোধের মধ্যে, প্ৰভেদের মধ্যে, বহুর মধ্যে বিচিত্র বিশেষে বিভক্ত । এইজনা যারা সেই অখণ্ড অদ্বৈতের সাধনা করেন তারা ব্ৰহ্মকে বিশেষ হতে মুক্ত করে বিশুদ্ধভাবে জানেন । ব্ৰহ্মকে নিবিশেষ জানেন । এবং এই নির্বিশেষকে উপলব্ধি করাকেই তারা জ্ঞানের চরম লক্ষ্য করেন । এই-যে অদ্বৈতের বিরাট সাধনা, ছোটাে বড়ো নানা মাত্রায় মানুষ এতে প্রবৃত্ত আছে। একেই মানুষ মুক্তি বলে । আপেল ফল পড়াকে মানুষ এক সময়ে একটা স্বতন্ত্র বিশেষ ঘটনা বলেই জানত "। তার পরে তাকে একটা বিশ্বব্যাপী অতিবিশেষের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে জ্ঞানের বন্ধনমোচন করে দিলে । এইটি করাতেই মানুষ জ্ঞানের সার্থকতা লাভ করলে । মানুষ অহংকারকে যখন একান্ত বিশেষ করে জানে তখন সে নিজের সেই আমিকে নিয়ে সকল দুষ্কৰ্মই করতে পারে । মানুষের ধর্মবোধ তাকে নিয়তই শিক্ষা দিচ্ছে, “তোমার আমিই একান্ত নয় । তোমার আমিকে সমাজ-আমির মধ্যে মুক্তি দাও ।” অর্থাৎ, তোমার বিশেষত্বকে অতিবিশেষের অভিমুখে নিয়ে চলো । -- এই অতিবিশেষের অভিমুখে যদি বিশেষত্বকে না নিয়ে যাই তা হলে সংসার নিদারুণ বিশিষ্ট মূর্তি ধারণ করে আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসে- তার সমস্ত পদার্থই একান্ত বোঝা হয়ে ওঠে । টাকা তখন অত্যন্ত একান্ত হয়ে উঠে অ-টাকাকে এমনি বিরুদ্ধ করে তোলে যে টাকার বোঝা কিছুতেই আর আমরা নামাতে পারি। নে । এই বন্ধন এই বোঝা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে মানুষের মধ্যে বড়ো বড়ো ভাব, মঙ্গলভাব, ধর্মভাব, কতরকম করে কাজ করছে। বড়োর মধ্যে ছোটোর বিশেষত্বগুলি নিজের ঐকান্তিকতা ত্যাগ করে ;