পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ရ Rğ नि কেতন (SA আর, যে মানুষের মুখেই দৃষ্টিপাত করেন— সে মুখই হােক আর পণ্ডিতই হােক, সে রাজচক্রবর্তী হােক আর দীন দরিদ্রই হােক- অমৃতের পুত্র বলে তার পরিচয় প্রাপ্ত হন। সেই যেদিন ভারতবর্ষের তপোবনে অনন্তের বার্তা এসে পৌঁচেছিল, সেদিন ভারতবর্ষ আপনাকে দিব্যধাম বলে জানতেন, সেদিন তিনি অমৃতের পুত্রদের সভায় অমৃতমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন ; সেদিন তিনি বলেছিলেন যন্তু সর্বণি ভুতানি আত্মনোবানুপশ্যতি সর্বভুতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুন্সতে । যিনি সর্বভূতকেই পরমাত্মার মধ্যে এবং পরমাত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন তিনি কাউকেই আর ঘূণা করেন না | ভারতবর্ষ বলেছিলেন— তে সর্বগং সর্বতঃ প্রাপ্য ধীরা যুক্তাত্মানঃ সর্বমেবাবিশন্তি । যিনি সর্বব্যাপী, তীকে সর্বত্রই প্রাপ্ত হয়ে তার সঙ্গে যোগযুক্ত ধীরেরা সকলের মধ্যেই প্রবেশ করেন। সেদিন ভারতবর্ষ নিখিল লোকের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন ; জলস্থল-আকাশকে পরিপূর্ণ দেখেছিলেন, উর্ধ্বপূৰ্ণংমধ্যপূর্ণমধঃপূর্ণং দেখেছিলেন। সেদিন সমস্ত অন্ধকার তীর কাছে উদঘাটিত হয়ে গিয়েছিল । তিনি বলেছিলেন— বেদাহং, আমি জেনেছি, আমি পেয়েছি। সর্বমানবকে অমৃতের পুত্র বলে আহবান করেছিলেন-- তীব ঘূণা ছিল না, অহংকার ছিল না। তিনি পরমাত্মার যোগে সকলের মধ্যেই প্ৰবেশ করেছিলেন । সেদিন তার আমন্ত্রণধ্বনি জগতের কোথাও সংকুচিত হয় নি ; তার ব্ৰহ্মমন্ত্র বিশ্বসংগীতের সঙ্গে একতানে মিলিত হয়ে নিত্যকালের মধ্যে প্ৰতিধ্বনিত হয়েছিল— সেই তার ছিল উৎসবের দিন । তার পরে বিধাতা জানেন কোথা হতে অপরাধ প্ৰবেশ করল । বিশ্বলোকের দ্বার চারি দিক হতে বন্ধ হতে লাগল, নির্বাপিত প্ৰদীপের মতো ভারতবর্ষ আপনার মধ্যে আপনি অবরুদ্ধ হল। প্রবল স্রোতস্বিনী যখন মরে আসতে থাকে তখন যেমন দেখতে দেখতে পদে পদে বালির চর জেগে উঠে তার সমুদ্ৰগামিনী ধারার গতিরোধ করে দেয়, তাকে বহুতর ছোটাে ছোটাে জলাশয়ে বিভক্ত করেযে ধারা দূরদূরান্তরের প্রাণদায়িনী ছিল, যা দেশদেশান্তরের সম্পদ বহন করে নিয়ে যেত, যে অশ্রান্ত ধারার কলধ্বনি জগৎসংগীতের তানপুরার মতো পর্বতশিখর থেকে মহাসমুদ্র পর্যন্ত নিরস্তর বাজতে থাকত, সেই বিশ্বকল্যাণীধারাকে কেবল খণ্ড খণ্ড ভাবে এক-একটা ক্ষুদ্র গ্রামের সামগ্ৰী করে তোলে, সেই খণ্ডতগুলি আপন পূর্বতন ঐক্যটিকে বিস্মৃত হয়ে বিশ্বনৃত্যে আর যোগ দেয় না, বিশ্বাগীতাসভায় আর স্থান পায় না- সেইরকম করেই নিখিল মানবের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্বন্ধের পুণ্যধারা সহস্ৰ সাম্প্রদায়িক বালুর চরে খণ্ডিত হয়ে গতিহীন হয়ে পড়ল। তার পরে, হায়, সেই বিশ্ববাণী কোথায় ? কোথায় সেই বিশ্বপ্রাণের তরঙ্গদোলা % রুদ্ধ জল। যেমন কেবলই ভয় পায় অল্পমাত্র অশুচিতায় পাছে তাকে কলুষিত কবে, এইজন্যে সে যেমন স্নান পানের নিষেধের দ্বারা নিজের চারি দিকে বেড়া তুলে দেয়, তেমনি আজ বদ্ধ ভারতবর্ষ কেবলই কলুষের আশঙ্কায় বাহিরের বৃহৎ সংস্রবকে সর্বতোভাবে দূরে রাখবার জন্যে নিষেধের প্রাচীর তুলে দিয়ে সূর্যালোক এবং বাতাসকে পর্যন্ত তিরস্কৃত করেছেন— কেবলই বিভাগ, কেবলই বাধা । বিশ্বের লোক গুরুর কাছে বসে যে দীক্ষা নেবে সে দীক্ষার মন্ত্র কোথায়, সে দীক্ষার অবারিত মন্দির কোথায় । সে আহবানবাণী কোথায় যে বাণী একদিন চারিদিকে এই বলে ধ্বনিত হয়েছিল যথাপঃ প্ৰবত যান্তি যথা মাসা অহৰ্জরাম এবং মাং ব্ৰহ্মচারিণো ধাতর আয়ত্ত্ব সৰ্ষতঃ স্বাহা । জল যেমন স্বভাবতই নিম্নদেশে গমন করে, মাসসকল যেমন স্বভাবতই সংবৎসরের দিকে ধাবিত হয়, তেমনি সকল দিক হইতেই ব্ৰহ্মচারিগণ আমার নিকট আসুন, স্বাহা । কিন্তু সেই স্বভাবের পথ যে আজ রুদ্ধ। ধর্ম জ্ঞান সমাজ তাদের সিংহদ্বার বন্ধ করে বসে আছে