পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(2&br রবীন্দ্র-রচনাবলী কেবল অন্তঃপুরের যাতায়াতের জন্যে খিড়কির দরজার ব্যবহার চলছে মাত্র । সত্যসম্পদের দারিদ্র্য না ঘটলে এমন দুৰ্গতি কখনোই হয় না । যে বলতে পেরেছে বেদাহং, আমি জেনেছি, তাকে বেরিয়ে আসতেই হবে— তাকে বলতেই হবে ; শূন্বস্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্ৰাঃ। এইরকম দৈন্যের নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে সমস্ত দ্বার জানলা বন্ধ করে যখন ঘুমোচ্ছিলুম। এমন সময় একটি ভোরের পাখির কণ্ঠ থেকে আমাদের রুদ্ধ ঘরের মধ্যে বিশ্বের নিত্যসংগীতের সুর এসে পৌঁছল— যে সুরে লোকলোকান্তর যুগযুগান্তর সুর মিলিয়েছে, যে সুরে পৃথিবীর ধূলির সঙ্গে সূর্য তারা একই আত্মীয়তার আনন্দে ঝংকৃত হয়েছে— সেই সুর একদিন শোনা গেল । আবার যেন কে বললে- বেদাহমেতং, আমি একে জেনেছি। কাকে জেনেছ ? আদিত্যবৰ্ণং— জ্যোতির্ময়কে জেনেছি, যাকে কেউ গোপন করতে পারে না | জ্যোতির্ময় ? কই তাকে তো আমার গৃহসামগ্রীর মধ্যে দেখছি নে । না, তোমার অন্ধকার দিয়ে ঢেকে তাকে তোমার ঘরের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখনি ! তাকে দেখছি তমসঃ পরস্তাৎ— তোমাদের সমস্ত রুদ্ধ অন্ধকারের পরপর হতে । তুমি যাকে তোমার সম্প্রদায়ের মধ্যে ধরে রেখেছ, পাছে আর কেউ সেখানে প্রবেশ করে বলে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছ, সে যে অন্ধকার । নিখিল মানব সেখান থেকে ফিরে ফিরে যায়, সূর্য চন্দ্র সেখানে দৃষ্টিপাত করে না । সেখানে জ্ঞানের স্থানে শাস্ত্রের বাক্য, ভক্তির স্থানে পূজাপদ্ধতি, কর্মের স্থানে অভ্যস্ত আচার। সেখানে দ্বারে একজন ভয়ংকর 'না' বসে আছে ; সে বলছে, ‘না, না, এখানে না দূরে যাও দূরে যাও । সে বলছে কান বন্ধ করো পাছে মন্ত্র কানে যায়, সরে বসে পাছে স্পর্শ লাগে, দরজা ঠেলো না পাছে তোমার দৃষ্টি পড়ে । এত 'না' দিয়ে তুমি যাকে ঢেকে রেখেছি আমি সেই অন্ধকারের কথা বলছি নে । কিন্তু— বেদাহমেতং, আমি তাকে জেনেছি। যিনি নিখিলের, যাকে জানলে আর কাউকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না, কাউকে ঘূণা করা যায় না— র্যাকে জানলে নিম্নদেশ যেমন জলসকলকে স্বভাবতই আহবান করে, সংবৎসর। যেমন মাসসকলকে স্বভাবতই আহবান করে, তেমনি স্বভাবত সকলকেই অবাধে আহবান করবার অধিকার জন্মে— তাকেই জেনেছি | ঘরের লোক ক্রুদ্ধ হয়ে ভিতর থেকে গর্জন করে উঠল— ‘দূর করো, দূর করো, একে বের করে দাও । এ তো আমার ঘরের সামগ্ৰী নয়। এ তো আমার নিয়মকে মানবে না।” না, এ তোমার ঘরের না, এ তোমার নিয়মের বাধ্য নয় । কিন্তু পারবে না- আকাশের আলোককে গায়ের জোর দিয়ে ঠেলে ফেলতে পারবে না । তার সঙ্গে বিরোধ করতে গেলেও তাকে স্বীকার করতে शत् । ॐ७७ ५6(अ(छ । প্রভাত এসেছে, আমাদের উৎসব। এই কথা বলছে । আমাদের এই উৎসব ঘরের উৎসব নয়, ব্ৰাহ্মসমাজের উৎসব নয়, মানবের চিত্তগগনে যে প্ৰভাতের উদয় হচ্ছে। এ যে সেই সুমহৎ প্ৰভাতের উৎসব । বহু যুগ পূর্বে এই প্রভাত-উৎসবের পবিত্র গভীর মন্ত্র এই ভারতবর্ষের তপোবনে ধ্বনিত হয়েছিল— একমেবাদ্বিতীয়ম। অদ্বিতীয় এক । পৃথিবীর এই পূর্বদিগন্তে আবার কোন জাগ্রত মহাপুরুষ অন্ধকার রাত্রির পরপর হতে সেই মন্ত্র বহন করে এনে স্তব্ধ আকাশের মধ্যে স্পন্দন সঞ্চার করে দিলেন- একমেবাদ্বিতীয়ম। অদ্বিতীয় এক । এই যে প্রভাতের মন্ত্র উদয়শিখরের উপরে দাড়িয়ে জানিয়ে দিলে যে, একসূর্য উদয় হচ্ছেন, এবার ছোটাে ছোটাে অসংখ্য প্ৰদীপ নেবাও । এ মন্ত্র কোনো এক ঘরের মন্ত্র নয়, এই প্ৰভাত কোনো একটি দেশের প্রভাত নয়- হে পশ্চিম, তুমিও শোনো, তুমি জাগ্রত হও । শৃশ্বন্তু বিশ্বে | হে বিশ্ববাসী, সকলে শোনো। পূর্বগগনের প্রান্তে একটি বাণী জেগে উঠেছে— বেদাহমেতং, আমি জানতে পারছি। তফসঃ পর্যন্তাৎ, অন্ধকারোয় পরপর থেকে আমি জানতে পারছি। নিশাৰাসানের আকাশ উদয়োম্মুখ আমিত্যের আসন্ন আবির্ভাবকে যেমন করে জানতে পারে তেমনি করে- ; বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পর্যন্তাৎ ৷ এই নুতন যুগে পৃথিবীর মানবচিত্তে যে প্রভাত আসছে সেই নব প্ৰভাতের বার্তা বাংলাদেশে আজ।