পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন GNN আশি বৎসর হল প্রথম এসে উপস্থিত হয়েছিল। তখন পৃথিবীতে দেশের সঙ্গে দেশের বিরোধ, ধর্মের সঙ্গে ধর্মের সংগ্রাম ; তখন শাস্ত্রবাক্য এবং বাহা প্রথার লীেহসিংহাসনে বিভাগই ছিল রাজা— সেই ভেদবুদ্ধির প্রাচীরব্রুদ্ধ অন্ধকারের মধ্যে রাজা রামমোহন যখন অদ্বিতীয় একের আলোক তুলে ধরলেন তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, যে ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান ও খ্রীস্টানধৰ্ম আজ একত্র সমাগত হয়েছে, সেই ভারতবর্ষেই বহু পূর্ব যুগে এই বিচিত্র অতিথিদের এক সভায় বসাবার জন্যে আয়োজন হয়ে গেছে। মানবসভ্যতা যখন দেশে দেশে নব নব বিকাশের শাখা-প্ৰশাখায় ব্যাপ্ত হতে চলেছিল তখন এই ভারতবর্ষ বারংবার মন্ত্র জপ করছিলেন— এক এক এক । তিনি বলছিলেন- ইহ চেৎ আবেদীৎ অৰ্থ সত্যমস্তি— এই এককেই যদি মানুষ জানে তবে সে সত্য হয় ৷ ন চেৎ ইহ আবেদীৎ মহতী বিনষ্টিঃ— এই এককে যদি না জানে তবে তার মহতী বিনষ্টি । এ-পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মিথ্যার প্রাদুর্ভাব হয়েছে সে কেবল এই মহান একের উপলব্ধি-অভাবে । যত ক্ষুদ্রতা নিস্ফলতা দৌর্বল্য সে এই একের থেকে বিচূতিতে ! যত মহাপুরুষের আবির্ভাব সে এই এককে প্রচার করতে। যত মহাবিপ্লবের আগমন সে এই এককে উদ্ধার করবার জন্যে । যখন ঘোরতর বিভাগ বিরোধ বিক্ষিপ্ততার দুর্দিনের মধ্যে এই বাংলাদেশে অপ্রত্যাশিত অভাবনীয় রূপে এই বিশ্বব্যাপী একের মন্ত্র 'একমেবাদ্বিতীয়ম দ্বিধাবিহীন সুস্পষ্ট স্বরে উচ্চারিত হয়ে উঠল তখন এ কথা নিশ্চয় জানতে হবে, সমস্ত মানবচিত্তে কোথা হতে একটি নিগৃঢ় জাগরণের বেগ সঞ্চারিত হয়েছে, এই বাংলাদেশে তার প্রথম সংবাদ ধ্বনিত হয়ে উঠেছে | আমাদের দেশে আজ বিরাট মানবের আগমন হয়েছে। এখানে আমাদের রাজ্য নেই, বাণিজ্য নেই, গীেরব নেই, পৃথিবীতে আমরা সকলের চেয়ে মাথা নিচু করে রয়েছি— আমাদেরই এই দরিদ্র ঘরের অপমানিত শূন্যতার মাঝখানে বিরাট মানবের অভু্যদয় হয়েছে। তিনি আজ আমাদেরই কাছে কর গ্ৰহণ করবেন বলে এসেছেন । সকল মানুষের কাছে নিত্যকালের ডালায় সাজিয়ে ধরতে পারি। এমন কোনো রাজদুর্লভ অৰ্ঘ আমাদের এখানে সংগ্রহ হয়েছে, নইলে আমাদের এ সৌভাগা হত না । আমাদের এই উৎসর্গ বটের তলায় নয়, ঘরের দালানে নয়, গ্রামের মণ্ডপে নয়, এ উৎসর্গ বিশ্বের প্রাঙ্গণে । এইখানেই তার প্রাপা নেবেন বলে বিশ্বমানব তার দূতকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ; তিনি আমাদের মন্ত্র দিয়ে গিয়েছেন— একমেবাদ্বিতীয়ম ৷ বলে গিয়েছেন, মনে রাখিস, সকল বৈচিত্র্যের মধ্যে মনে রাখিস অদ্বিতীয় এক | সকল বিরোধের মধ্যে ধরে রাখিস অদ্বিতীয় এক ৷” সেই মন্ত্রের পর থেকেই আর আমাদের নিদ্রা নেই দেখছি । ’এক’ আমাদের স্পর্শ করেছেন, আর আমরা সুস্থির থাকতে পারছি নে । আজ আমরা ঘর ছেড়ে, দল ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে বিশ্বপথের পথিক হব বলে চঞ্চল হয়ে উঠেছি। এ পথের পাথেয় আছে বলে জানতুম না- এখন দেখছি অভাব নেই। ঘরে বাহিরে অনৈক্যের দ্বারা যারা নিতান্ত বিচ্ছিন্ন, সমস্ত মানুষের মধ্যে তারাই ‘এক কে প্রচার করবার হুকুম পেয়েছে ; এক জায়গায় সম্বল আছে বলেই এমন হুকুম এসে পৌঁছল। তার পর থেকে আনাগোনা তো চলেইছে ; একে একে দূত আসছে। এই দেশে এমন একটি বাণী তৈরি হচ্ছে যা পূর্বপশ্চিমকে এক দিবাধামে আহবান করবে, যা একের আলোকে অমৃতের পুত্ৰগণকে অমৃতের পরিচয়ে মিলিত করবে। রামমোহন রায়ের আগমনের পর থেকে আমাদের দেশের চিন্তা বাক্য ও কর্ম, সম্পূর্ণ না জেনেও, একটি চিরন্তােনর অভিমুখে চলেছে। আমরা কোনো একটি জায়গায় নিতাকে লাভ করব এবং প্রকাশ করব এমন একটি গভীর আবেগ আমাদের অন্তরের মধ্যে জোয়ারের প্রথম টানের মতো স্ফীত হয়ে উঠেছে ; আমরা অনুভব করছি--- সমাজের সঙ্গে সমাজ, বিজ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞান, ধর্মের সঙ্গে ধর্ম যে এক পরমতীর্থে এক সাগরসংগমে পুণ্যস্নান করতে পারে তারই রহস্য যে একটি প্রাচীন গুরুকুল ছিল সেই গুরুকুলের দ্বার আবার যেন এখনই খুলবে। এমনি আমাদের মনে হচ্ছে । কেননা কিছুকাল পূর্বে যেখানে একেবারে নিঃশব্দ ছিল এখন যে সেখানে কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে । আর ঐ যে দেখছি বাতায়নে এক-একজন মাঝে মাঝে এসে দাড়াচ্ছেন, তাদের মুখ দেখে চেনা