পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V)のひ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী যাচ্ছে তারা মুক্ত পৃথিবীর লোক, তারা নিখিল মানবের আত্মীয় । পৃথিবীতে কালে কালে যে-সকল মহাপুরুষ ভিন্ন ভিন্ন দেশে আগমন করেছেন সেই যাজ্ঞবল্ক্য বিশ্বামিত্র বুদ্ধ খ্রীস্ট মহম্মদ সকলকেই র্তারা ব্ৰহ্মের বলে চিনেছেন ; তারা মৃত বাক্য মৃত আচারের গোরস্থানে প্রাচীর তুলে বাস করেন না । র্তাদের বাক্য প্রতিধ্বনি নয়, কার্য অনুকরণ নয়, গতি অনুবৃত্তি নয় ; তারা মানবাত্মার মাহাত্ম্য-সংগীতকে এখনই বিশ্বলোকের রাজপথে ধ্বনিত করে তুলবেন । সেই মহাসংগীতের মূল ধুয়াটি আমাদের গুরু, ধরিয়ে দিয়ে গেছেন— একমেবাদ্বিতীয়ম। সকল বিচিত্র তানকেই এই ধুয়াতেই বারংবার ফিরিয়ে আনতে হবে- একমেবাদ্বিতীয়ম। আর আমাদের লুকিয়ে থাকবার জো নেই। এবার আমাদের প্রকাশিত হতে হবে।-- ব্রহ্মেধ আলোকে সকলের সামনে প্রকাশিত হতে হবে । বিশ্ববিধাতার নিকট থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে সমুদয় মানুষের কাছে এসে দাড়াতে হবে । সেই পরিচয়পত্রটি তিনি তার দূতকে দিয়ে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন । কোন পরিচয় আমাদের ? আমাদের পরিচয় এই যে, আমরা তারা, যারা বলে না যে, ঈশ্বর বিশেষ স্থানে বিশেষ স্বাগ প্রতিষ্ঠিত । আমরা তারাই যারা বলে— একোবশী সর্বভূতান্তরাত্মা ! সেই এক প্রভূই সর্বভূতের অন্তরাত্মা | আমরা তারাই যারা বলে না যে, বাহিরের কোনো প্রক্রিয়া-দ্বারা ঈশ্বরকে জানা যায় অথবা কোনো বিশেষ শাস্ত্ৰে ঈশ্বরের জ্ঞান বিশেষ লোকের জন্যে আবদ্ধ হয়ে আছে | আমবা বলি-- হাঁদা মনীষা মনসাভিকম গুঃ, হৃদয়স্থিত সংশয়ারহিত বুদ্ধির দ্বারাই তাকে জানা যায় । আমরা তারাই যারা ঈশ্বরকে কোনো বিশেষ জাতির বিশেষ লভা বলি নে । আমরা বলি তিনি অবর্ণ এবং— বৰ্ণামনেকান্নিহিতার্থে দধতি, সর্ব বর্ণেরই প্রয়োজন বিধান করেন, কোনো বর্ণকে বঞ্চিত করেন না ; আমরা তারাই যারা এই বাণী ঘোষণার ভার নিয়েছি- এক, এক, অদ্বিতীয় এক ; তবে আমরা আর স্থানীয় ধর্ম এবং সাময়িক লোকাচারের মধ্যে বাধা পড়ে থাকিব কেমন করে । আমরা একের আলোকে সকলের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে প্রকাশ পাব । আমাদের উৎসব সেই প্রকাশের উৎসব, সেই বিশ্বলোকের মধ্যে প্রকাশের উৎসব, সেই কথা মনে রাখতে হবে । এই উৎসবে, সেই প্ৰভাতের প্রথম রশ্মিপাত হয়েছে যে প্রভাত একটি মহাদিনেব অভূদয় সূচনা করছে ; সেই মহাদিন এসেছে, অথচ এখনো সে আসে নি । অনাগত মহাভবিষ্যতে তার মূর্তি দেখতে পাচ্ছি । তার মধ্যে যে সত্য বিরাজ করছে সে তো এমন সত্য নয় যাকে আমরা একেবারে লাভ করে আমাদের সম্প্রদায়ের লোহার সিন্দুকে দলিল-দস্তাবেজের সঙ্গে চাবি বন্ধ করে বসে আছি, যাকে বলধ এ আমাদের ব্ৰাহ্মসমাজের, ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের । না । আমরা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করি নি ; আমরা যে কিসের জন্য এই উৎসবকে বর্ষে বর্ষে বহন করে আসছি তা ভালো করে বুঝতে পারি নি । আমরা স্থির করেছিলুম। এই দিনে একদা ব্ৰাহ্মসমাজ স্থাপিত হয়েছিল, আমরা ব্ৰাহ্মীরা তাই উৎসব করি । কথাটা এমন ক্ষুদ্র নয় । এষ দেবো বিশ্বকর্ম মহাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ, এই যে মহান আত্মা, এই যে বিশ্বকর্মী দেবতা, যিনি সর্বদা জনগণের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট আছেন, তিনিই আজ বর্তমান যুগে জগতে ধৰ্মসমন্বয় জাতিসমন্বয়ের আহবান এই অখ্যাত বাংলাদেশের দ্বার হতে প্রেরণ করেছেন । আমরা তাই বলছি। ধনা, ধনা, আমরা ধনা । এই আশ্চৰ্য ইতিহাসের আনন্দকে আমরা মাঘোৎসবে জাগ্রত করছি । এই মহৎসত্যে আজ আমাদের উদবোধিত হতে হবে, বিধাতার এই মহতী কৃপায় যে গম্ভীর দায়িত্ব তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে । বৃদ্ধিকে প্রশস্ত করো, হৃদয়কে প্রসারিত করো, নিজেকে দরিদ্র বলে জেনো না, দুর্বল বলে মেনে না । তপস্যায় প্রবৃত্ত হও, দুঃখকে বরণ করো, ক্ষুদ্র সমাজের মধ্যে আরাম ভোগ করবার জন্যে জ্ঞানকে মৃতপ্রায় এবং কর্মকে যন্ত্রবৎ কোরো না- সীতাকে সকলের উর্ধের্ব স্বীকার করো এবং ব্রহ্মের আনন্দে জীবনকে পরিপূর্ণ করে অভয় প্রতিষ্ঠা লাভ করো। হে জনগণের হৃদয়াসন-সন্নিবিষ্ট বিশ্বকর্ম, তুমি যে আজ আমাদের নিয়ে তোমার কোন মহৎকর্ম রচনা করছ, হে মহান আত্মা, তা এখনো আমরা সম্পূৰ্ণ বুঝতে পারি নি । তোমার ভগবৎশক্তি আমাদের বুদ্ধিকে কোনখানে স্পর্শ করেছে, সেখানে কোথায় তোমার সৃষ্টিলীলা চলছে, তা এখনো আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। জগৎ-সংসারে আমাদের গৌরবান্বিত ভাগ্য যে কোন দিগন্তরালে