পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VO S90 চেতনাকে যেন উদবোধিত করে দিই। আর বেশি কিছু নয়, আমরা প্রতিদিন প্ৰভাতে সেই যিনি শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং তার সম্মুখে দাড়িয়ে তার আশীর্বাদ গ্ৰহণ করব। তাকে নত হয়ে প্ৰণাম করে বলব, “তোমার পায়ের ধুলো নিলুম, আমার ললাট নির্মল হয়ে গেল। আজ আমার সমস্ত দিনের জীবনযাত্রার পাথেয় সঞ্চিত হল। প্রাতে তােমার সম্মুখে দাঁড়িয়েছি, তােমাকে প্ৰণাম করেছি, তোমার পদধূলি মাথায় তুলে সমস্ত দিনের কর্মে নির্মল সতেজভাবে তার, পরিচয় বহন করব।” ২ ফাল্গুন ১৩১৫ অন্তর বাহির আমরা মানুষ, মানুষের মধ্যে জন্মেছি । এই মানুষের সঙ্গে নানাপ্রকার মেলবার জন্যে, তাদের সঙ্গে নানাপ্রকার, আবশ্যকের ও আনন্দের আদানপ্রদান চালাবার জন্যে আমাদের অনেকগুলি প্রবৃত্তি আছে। আমরা লোকালয়ে যখন থাকি তখন মানুষের সংসর্গে উত্তেজিত হয়ে সেই-সমস্ত প্রবৃত্তি নানা দিকে নানা প্রকারে নিজেকে প্রয়োগ করতে থাকে । কত দেখাশোনা, কত হাস্যালাপ, কত নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ, কত লীলাখেলায় সে যে নিজেকে ব্যাপৃত করে তার সীমা নেই। মানুষের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক প্রেমবশতই যে আমাদের এই চাঞ্চল্য এবং উদ্যম প্রকাশ পায় তা নয় । সামাজিক এবং প্রেমিক একই লোক নয়- অনেক সময় তার বিপরীতই দেখতে পাই । অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় সামাজিক ব্যক্তির মনে গভীরতর প্রেমু ও দয়ার স্থান নেই। সমাজ আমাদের ব্যাপৃত রাখে ; নানাপ্রকার সামাজিক আলাপ, সামাজিক কাজ, সামাজিক আমোদ সৃষ্টি করে আমাদের মনের উদ্যমকে আকর্ষণ করে নেয়। এই উদ্যমকে কোন কাজে লাগিয়ে কেমন করে মনকে শান্ত করব সে কথা আর চিন্তা করতেই হয় না— লোক, লীেকিকতার বিচিত্র কৃত্রিম নালায় আপনি সে প্রবাহিত হয়ে যায় । যে ব্যক্তি অমিতব্যয়ী সে যে লোকের দুঃখ দূর করবার জন্যে দান করে নিজেকে নিঃস্ব করে তা নয়- ব্যয় করবার প্রবৃত্তিকে সে সংবরণ করতে পারে না । নানা রকমের খরচ করে তার উদ্যম ছাড়া পেয়ে খেলা করে খুশি হয় । সমাজে আমাদের সামাজিকতা বহুলাংশে সেই ভাবে নিজের শক্তিকে খরচ করে, সে যে সমাজের লোকের প্রতি বিশেষ প্রতিবশত তা নয়, কিন্তু নিজেকে খরচ করে ফেলবার একটা প্রবৃত্তি-বশত চর্চাদ্বারা এই প্রবৃত্তি কিরকম অপরিমিতিরূপে বেড়ে উঠতে পারে তা যুরোপে যারা সমাজবিলাসী তাদের জীবন দেখলে বোঝা যায়। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত তাদের বিশ্রাম নেই- উত্তেজনার পর উত্তেজনার আয়োজন। কোথায় শিকার, কোথায় নাচ, কোথায় খেলা, কোথায় ভোজ, কোথায় ঘোড়দৌড়, এই নিয়ে তারা উন্মত্ত। তাদের জীবন কোনো লক্ষ্য স্থির করে কোনো পথ বেয়ে চলছে । না ; কেবল দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি, এই উন্মাদনার রাশিচক্রে ঘুরছে। আমাদের জীবনীশক্তির মধ্যে এত বেশি বেগ নেই বলে আমরা এতদূর যাই নে, কিন্তু আমরাও সমস্ত দিন অপেক্ষাকৃত মৃদুতরভাবে সামাজিক বাধা পথে কেবলমাত্র মনের শক্তিকে খরচ করবার জন্যেই খরচ করে থাকি । মনকে মুক্তি দেবার, শক্তিকে খাটিয়ে নেবার আর কোনো উপায় আমরা জানি নে । । দানে এবং ব্যয়ে অনেক তফাত । আমরা মানুষের জন্যে যা দান করি তা এক দিকে খরচ হয়ে অন্য দিকে মঙ্গলে পূর্ণ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষের কাছে যা ব্যয় করি তা কেবলমাত্রই খরচ। তাতে দেখতে পাই আমাদের গভীরতর চিত্ত কেবলই নিঃস্ব হতে থাকে, সে ভরে ওঠে না । তার শক্তি হ্রাস হয়, তার ক্লান্তি আসে, অবসাদ আসে- নিজের রিক্ততা ও ব্যর্থতার ধিক্কারকে ভুলিয়ে রাখবার জন্যে Գ||S)S ነ