পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VSA অভ্যাস যিনি পরম চৈতন্যস্বরূপ তাকে আমরা নির্মল চৈতন্যের দ্বারাই অন্তরাত্মার মধ্যে উপলব্ধি করব। এই রয়েছে কথা । তিনি আর কোনোরকমে সস্তায় আমাদের কাছে ধরা দেবেন না— এতে যতই বিলম্ব হোক। সেইজন্যেই তার দেখা দেওয়ার অপেক্ষায় কোনো কাজ বাকি নেই- আমাদের আহার ব্যবহার প্রাণন-মনন সমস্তই চলছে । আমাদের জীবনের যে বিকাশ তার দর্শনে গিয়ে পরিসমাপ্ত সে ধীরে ধীরে হােক, বিলম্বে হােক, সেজন্যে তিনি কোনো অস্ত্ৰধারী পেয়াদাকে দিয়ে তাগিদ পাঠাচ্ছেন না। সেটি একটি পরিপূর্ণ সামগ্ৰী কি না, অনেক রৌদ্রবৃষ্টির পরম্পরায়— অনেক দিন ও রাত্রির শুশ্রুষায় তার হাজারটি দল একটি বৃন্তে ফুটে উঠবে। " সেইজন্যে মাঝে মাঝে আমার মনে এই সংশয়টি আসে যে, এই যে আমরা প্ৰাতঃকালে উপাসনার জন্যে অনেকে সমবেত হয়েছি, এখানে আমরা অনেক সময়েই অনেকেই আমাদের সম্পূর্ণ চিত্তটিকে তো আনতে পারি নে- তবে এ কাজটি কি আমাদের ভালো হচ্ছে ? নির্মল চৈতনোর স্থানে অচেতন্যপ্রায় অভ্যাসকে নিযুক্ত করায় আমরা কি অন্যায় করছি নে ? আমার মনে এক-এক সময় অত্যন্ত সংকোচ বোধ হয় | মনে ভাবি যিনি আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যে আমাদের ইচ্ছার উপর কিছুমাত্র জবরদস্তি করেন না তার উপাসনায় পাছে আমরা লেশমাত্র অনিচ্ছাকে নিয়ে আসি, পাছে এখানে আসবার সময় কিছুমাত্র ক্লেশ বোধ করি, কিছুমাত্র আলসের বাধা ঘটে, পাছে তখন কোনো আমোদের বা কাজের আকর্ষণে আমাদের ভিতরে ভিতরে একটা বিমুখতার সৃষ্টি করে। উপাসনায় শৈথিল করলে, অনা যারা উপাসনা করেন তারা যদি কিছু মনে করেন, যদি কেউ নিন্দ করেন বা বিরক্ত হন, পাছে এই তাদিগটাই সকলের চেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে । সেইজন্যে এক-এক সময়ে বলতে ইচ্ছা করে মন সম্পূর্ণ অনুকূল সম্পূৰ্ণ ইচ্ছুক না হলে এ জায়গায় কেউ এসো না | কিন্তু সংসারটা যে কী জিনিস তা যে জানি । এ সংসারের অনেকটা পথ মাড়িয়ে আজ বার্ধক্যের দ্বারে এসে উত্তীর্ণ হয়েছি। জানি দুঃখ কাকে বলে, আঘাত কী প্রচণ্ড, বিপদ কেমন অভাবনীয় | যে-সময়ে আশ্রয়ের প্রয়োজন সকলের বেশি সেই সময়ে আশ্রয় কিরূপ দুর্লভ । তিনিহীন জীবন যে অত্যন্ত গৌরবহীন, চার দিকেই তাকে টানাটানি করে মারে । দেখতে দেখতে তার সুর নেবে যায়, তার কথা চিন্তা কাজ তুচ্ছ হয়ে আসে । সে জীবন যেন অনাবৃত— সে এবং তার বাইরের মাঝখানে কেউ যেন তাকে ঠেকাবার নেই । ক্ষতি একেবারেই তার গায়ে এসে লাগে, নিন্দা একেবারেই তার মর্মে এসে আঘাত করে, দুঃখ কোনো ভাবরসের মাঝখান দিয়ে সুন্দর বা মহৎ হয়ে ওঠে না । সুখ একেবারে মত্ততা এবং শোকের কারণ একেবারে মৃত্যুবাণ হয়ে এসে তাকে বাজে। এ কথা যখন চিন্তা করে দেখি তখন সমস্ত সংকোচ মন হতে দূর হয়ে যায়— তখন ভীত হয়ে বলি, না, শৈথিল করলে চলবে না। একদিনও ভুলব না, প্রতিদিনই তার সামনে এসে দাঁড়াতেই হবে, প্রতিদিন কেবল সংসারকেই প্রশ্রয় দিয়ে তাকেই কেবল বুকের সমস্ত রক্ত খাইয়ে প্রবল করে তুলে নিজেকে এমন অসহায়ভাবে একান্তই তার হাতে আপাদমস্তক সমর্পণ করে দেব না, দিনের মধ্যে অন্তত একবার এই কথাটা প্রত্যহই বলে যেতে হবে— “তুমি সংসারের চেয়ে বড়ো— তুমি সকলের চেয়ে বড়ো।” যেমন করে পারি তেমনি করেই বলব। আমাদের শক্তি ক্ষুদ্র অন্তর্যামী তা জানেন । কোনোদিন আমাদের মনে কিছু জাগে কোনোদিন একেবারেই জাগে না- মনে বিক্ষেপ আসে, মনে ছায়া পড়ে। উপাসনার যে-মন্ত্র আবৃত্তি করি প্রতিদিন তার অর্থ উজ্জ্বল থাকে না। কিন্তু তবু নিষ্ঠ হারাব না। দিনের পর দিন এই দ্বারে এসে দাড়াব, দ্বার খুলুক আর নাই। খুলুক। যদি এখানে আসতে কষ্ট বোধ হয় তবে সেই কষ্টকে অতিক্রম করেই আসব। যদি সংসারের কোনো বন্ধন মনকে টেনে রাখতে চায়। তবে ক্ষণকালের জন্যে সেই সংসারকে এক পাশে ঠেলে রেখেই আসব। কিছু না-ই জোটে যদি তবে এই অভ্যাসটুকুকেই প্রত্যহ তঁর কাছে এনে উপস্থিত করব। সকলের