পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VeNRS করিয়ে দেয়, তখন সেই বৃহৎ পরিচয়ের ভিতর দিয়ে ফিরে এসে প্রত্যেক স্বাতন্ত্রা সেই ভূমার রসে রসপরিপর্ণ হয়ে ওঠে । একদিন যাদের বানান করে পড়তে হচ্ছিল, যারা পদে পদে আমাদের পথরোধ করছিল, তারা প্রত্যেকে সেই ভূমীর প্রতিই আমাদের বহন করে, রোধ করে না। তখন যে আনন্দ সেই আনন্দই প্ৰেম । সেই প্রেমে বেঁধে রাখে না- সেই প্রেমে টেনে নিয়ে যায় । নির্মল নির্বািধ প্ৰেম । সেই প্রেমই মুক্তি-— সমস্ত আসক্তির মৃত্যু এই মৃত্যুরই সৎকারমন্ত্র হচ্ছে— মধুবাতা ঋতীয়তে মধুক্ষরন্তি সিন্ধবঃ মাধবীনঃ সন্তোষধীঃ । মধু নক্তম উতোষসে মধুমৎ পার্থিবং রজঃ মধুমান্নো বনস্পতির্মধূমাং অস্তু সূৰ্যঃ । বায়ু মধু বহন করছে, নদীসিন্ধুসকল মঞ্চ ক্ষরণ করছে । ওষধিবনস্পতিসকল মধুময় হােক, রাত্ৰি মধু হােক, উষা মধু হােক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হােক, সূর্য মধুমান হােক । যখন আসক্তির বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে তখন জলস্থল আকাশ, জড়জন্তু মনুষ্য, সমস্তই অমৃতে পরিপূর্ণ— তখন আনন্দের অবধি নেই। আসক্তি আমাদের চিত্তকে বিষয়ে আবদ্ধ করে । চিত্ত যখন সেই বিষয়ের ভিতরে বিষয়াতীত সত্যকে লাভ করে তখন প্রজাপতি যেমন গুটি কেটে বের হয় তেমনি সে বৈরাগ্য-দ্বারা আসক্তিবন্ধন ছিন্ন করে ফেলে। আসক্তি ছিন্ন হয়ে গেলেই পূর্ণ সুন্দর প্ৰেম আনন্দরূপে সর্বত্রই প্রকাশ পায়। তখন, আনন্দরূপমমৃতং যদবিভতি— এই মন্ত্রের অর্থ বুঝতে পারি। যা-কিছু প্রকাশ পাচ্ছে সমস্তই সেই আনন্দরূপ, সেই অমৃতরূপ। কোনো বস্তুই তখন আমি প্রকাশ হচ্ছি বলে আর অহংকার করে না, প্রকাশ হচ্ছেন কেবল আনন্দ, কেবল আনন্দ । সেই প্রকাশের মৃত্যু নেই । মৃত্যু অন্য সমস্তের, কিন্তু সেই প্রকাশই অমৃত । ১৫ ফায়ুন ১৩১৫ বিশ্বাস সাধনা-আরম্ভে প্রথমেই সকলের চেয়ে একটি বড়ো বাধা আছে- সেইটি কাটিয়ে উঠতে পারলে অনেকটা কাজ এগিয়ে যায় । সেটি হচ্ছে প্রত্যয়ের বাধা । অজ্ঞাতসমূদ্র পার হয়ে একটি কোনো তীরে গিয়ে ঠেকবই এই নিশ্চিত প্রত্যয়ই হচ্ছে কলম্বসের সিদ্ধির প্রথম এবং মহৎ সম্বল। আরো অনেকেই আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌছোতে পারত, কিন্তু তাদের দীনচিত্তে ভরসা ছিল না ; তাদের বিশ্বাস উজ্জ্বল ছিল না। যে, কুল আছে; এইখনেই কলম্বসের সঙ্গে তাদের পার্থক্য। আমরাও অধিকাংশ লোক সাধনসমুদ্রে যে পাড়ি জমাই নে তার প্রধান কারণ— আমাদের অত্যন্ত নিশ্চিত প্রত্যয় জন্মে নি যে, সে সমুদ্রের পর আছে। শাস্ত্র পড়েছি, লোকের কথাও শুনেছি, মুখে বলি ই-ই বটে-বটে, কিন্তু মানবজীবনের যে একটা চরম লক্ষ্য আছে সে-প্রত্যয় নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হয় নি । এইজন্য ধর্মসাধনটা নিতান্তই বাহ্যব্যাপার, নিতান্তই দশজনের অনুকরণ মাত্র হয়ে পড়ে । আমাদের সমস্ত আন্তরিক চেষ্টা তাতে উদবোধিত হয় নি । t এই বিশ্বাসের জড়তা-বশতই লোককে ধর্মসাধনে প্রবৃত্ত করতে গেলে আমরা তাকে প্রতারণা করতে চেষ্ট করি, আমরা বলি এতে পুণ্য হবে । পুণ্য জিনিসটা কী ? না, পুণ্য হচ্ছে একটি হ্যান্ডনেট যাতে ভগবান আমাদের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন, কোনো একরকম টাকায় তিনি কোনো এক সময়ে সেটা পরিশোধ করে দেবেন।