পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

W SR SR রবীন্দ্র-রচনাবলী এইরকম একটা সুস্পষ্ট পুরস্কারের লোভ আমাদের স্কুল প্রত্যয়ের অনুকূল। কিন্তু সাধনার লক্ষ্যকে এইরকম বহির্বিষয় করে তুললে তার পথও ঠিক অন্তরের পথ হয় না, তার লাভও অন্তরের লাভ হয়। না। সে একটা পারলৌকিক বৈষয়িকতার সৃষ্টি করে। সেই বৈষয়িকতা অন্যান্য বৈষয়িকতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় । কিন্তু সাধনার লক্ষ্য হচ্ছে মানবজীবনের চরম লক্ষ্য । সে লক্ষ্য কখনোই বাহিরের কোনো স্থান নয়, যেমন স্বৰ্গ ; বাহিরের কোনাে পদ নয়, যেমন ইন্দ্ৰপদ ; এমন কিছুই নয় যাকে দূরে গিয়ে সন্ধান করে বের করতে হবে, যার জন্যে পাণ্ডা পুরোহিতের শরণাপন্ন হতে হবে। এ কিছুতে হতেই পারে না। মানবজীবনের চরম লক্ষ্য কী এই প্রশ্নটি নিজেকে জিজ্ঞাসা করে নিজের কাছ থেকে এর একটি স্পষ্ট উত্তর বের করে নিতে হবে । কারও কোনো শোনা কথায় এখানে কাজ চলবে না— কেননা এটি কোনো ছোটো কথা নয়, এটি একেবারে শেষ কথা । এটিকে যদি নিজের অন্তরাত্মার মধ্যে না পাই তবে বাইরে খুঁজে পাব না । এই বিশাল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের মাঝখানে আমি এসে দাঁড়িয়েছি। এটি একটি মহাশ্চর্য ব্যাপার। এর চেয়ে বড়ো ব্যাপার আর কিছু নেই। আশ্চর্য এই আমি এসেছি— আশ্চর্য এই চারি দিক । এই যে আমি এসে দাঁড়িয়েছি, কেবল খেয়ে ঘুমিয়ে গল্প করে কি এই আশ্চর্যটাকে ব্যাখ্যা করা যায় ? প্রবৃত্তির চরিতার্থতাই কি একে প্রতিমুহূর্তে অপমানিত করবে এবং শেষ মুহূর্তে মৃত্যু এসে একে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে ? এই ভুর্ভুবঃস্বলোকের মাঝখানটিতে দাড়িয়ে নিজের অন্তরাকাশের চৈতন্যলোকের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে- কেন ? এ-সমস্ত কী জন্যে ? এ প্রশ্নের উত্তর জল-স্থল-আকাশের কোথাও নেই- এ প্রশ্নের উত্তর নিজের অন্তরের মধ্যে নিহিত হয়ে রয়েছে । এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে আত্মাকে পেতে হবে । এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো কথা নেই । আত্মাকেই সত্য করে, পূর্ণ করে জানতে হবে । আত্মাকে যেখানে জানলে সত্য জানা হয় সেখানে আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি নে ! এইজন্যে আত্মাকে জানা বলে যে একটা পদার্থ আছে। এই কথাটা আমাদের বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই এসে পৌছোয় না | আত্মাকে আমরা সংসারের মধ্যেই জানতে চাচ্ছি। তাকে কেবলই ঘর-দুয়োর ঘটিবাটির মধ্যেই জানিছি। তার বেশি তাকে আমরা জানিই নে- এইজন্যে তাকে পাচ্ছি। আর হারাচ্ছি, কেবল কঁদছি আর ভয় পাচ্ছি। মনে করছি এটা না পেলেই আমি মলুম, আর ওটা পেলেই একেবারে ধন্য হয়ে গেলুম । এটাকে এবং ওটাকেই প্রধান করে জানছি, আত্মাকে তার কাছে খর্ব করে সেই প্ৰকাণ্ড দৈন্যের বোঝাকেই ঐশ্বর্যের গর্বে বহন করছি । আত্মাকে সত্য করে জানলেই আত্মার সমস্ত ঐশ্বৰ্য লাভ হয়। মৃত্যুর সামগ্ৰীর মধ্যে অহরহ তাকে জড়িত করে তাকে শোকের বাম্পে ভয়ের অন্ধকারে লুপ্তপ্রায় করে দেখার দুদিন কেটে যায় । পরমাত্মার মধ্যেই তার পরিপূর্ণ সত্য পরিপূর্ণ স্বরূপ প্রকাশ পায়— সংসারের মধ্যে নয়, বিষয়ের মধ্যে নয়, তার নিজের অহংকারের মধ্যে নয় । আত্মা সত্যের পরিপূর্ণতার মধ্যে নিজেকে জানবে, সেই পরম উপলব্ধি -দ্বারা সে বিনাশকে একেবারে অতিক্রম করবে । সে জ্ঞানজ্যোতির নির্মলতার মধ্যেই নিজেকে জানবে । কামক্ৰোধলোভ যে-সমস্ত বিকারের অন্ধকার রচনা করে, তার থেকে আত্মা বিশুদ্ধ শুভ্ৰ নিমুক্ত পবিত্রতার মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে এবং সর্বপ্রকার আসক্তির মৃত্যুবন্ধন থেকে প্রেমের অমৃতলোকে মুক্তিলাভ করে সে নিজেকে অমর বলেই জানবে । সে জানবে কার প্রকাশের মধ্যে তার প্রকাশ সত্য- সেই আবিঃ সেই প্রকাশস্বরূপকেই সে আত্মার পরম প্রকাশ বলে নিজের সমস্ত দৈন্য দূর করে দেবে এবং অন্তরে বাহিরে সর্বত্রই একটি প্ৰসন্নতা লাভ করে সে স্পষ্ট জানতে পারবে সে চিরদিনের জন্যে রক্ষা পেয়েছে। সমস্ত ভয় হতে, সমস্ত শোক হতে, সমস্ত ক্ষুদ্রতা হতে রক্ষা পেয়েছে। আত্মাকে পরমাত্মার মধ্যে লাভ করাই যে জীবনের চরম লক্ষ্য, এই লক্ষ্যটিকে একান্ত প্ৰত্যয়ের