পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী তার পরে লক্ষ্যটি বাইরে না ভিতরে, পরিধিতে না কেন্দ্ৰে, সেটি জানা চাই ; তার পরে চাই সোজা পথ বেয়ে চলতে শেখা । স্থৈর্য এবং গতি দুই চাই । বিশ্বাসে চিত্ত স্থির হবে- এবং সাধনায় চেষ্টা গতি লাভ করবে । ১৬ ফাল্গুন ১৩১৫ । निष्ठा যখন সিদ্ধির মূর্তি কিছু পরিমাণে দেখা দেয় তখন আনন্দে আমাদের আপনি টেনে নিয়ে চলে— তখন থামায় কার সাধ্য । তখন শ্রান্তি থাকে না, দুর্বলতা থাকে না । কিন্তু সাধনার আরম্ভেই সেই সিদ্ধির মূর্তি তো নিজেকে এমন করে দূর থেকেও প্রকাশ করে না । অথচ পথটিও তো সুগম পথ নয় । চলি কিসের জোরে ? এই সময়ে আমাদের চালাবার ভার যিনি নেন তিনিই নিষ্ঠ । ভক্তি যখন জাগে, হৃদয় যখন পূর্ণ হয়, তখন তো আর ভাবনা থাকে না ; তখন তো পথকে আর পথ বলেই জ্ঞান হয় না, তখন একেবারে উড়ে চলি । কিন্তু ভক্তি যখন দূরে, হৃদয় যখন শূন্য, সেই অত্যন্ত দুঃসময়ে আমাদের সহায় কে ? তখন আমাদের একমাত্ৰ সহায় নিষ্ঠ ! শুষ্ক চিত্তের মৃতভারকে সেই বহন করতে পারে । মরুভূমির পথে যাদের চলতে হয় তাদের বাহন হচ্ছে উট । অত্যন্ত শক্ত সবল বাহন— এর কিছুমাত্র শৌখিনতা নেই । খাদ্য পাচ্ছে না। তবু চলছে ৷ পানীয় রস পাচ্ছে না। তবু চলছে। বালি তপ্ত হয়ে উঠেছে। তবু চলছে, নিঃশব্দে চলছে । যখন মনে হয় সামনে বুঝি। এ মরুভূমির অন্ত নেই, বুঝি মৃত্যু ছাড়া আর গতি নেই, তখনো তার চলা বন্ধ হয় না ! তেমনি শুষ্কতা রিক্ততার মরুপথে কিছু না খেয়ে, কিছু না পেয়েও, আমাদের চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে সে কেবল নিষ্ঠা--- তার এমনি শক্ত প্ৰাণ যে নিন্দাগ্রানির ভিতর থেকে, কাঁটাগুলোর মধ্যে থেকেও, সে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে পারে । যখন মরুবায়ুর মৃত্যময় ঝঞা উন্মত্তের মতো ছুটে আসে, তখন সে ধুলোর উপর মাথা সম্পূৰ্ণ নত করে ঝড়কে মাথার উপর দিয়ে চলে যেতে দেয় । তার মতো এমন ধীর সহিষ্ণু এমন অধ্যবসায়ী কে আছে ? একঘেয়ে একটানা প্ৰান্তর । মাঝে মাঝে কেবল কল্পনার মরীচিকা পথ ভোলাতে আসেসার্থকতার বিচিত্র রূপ ক্ষণে ক্ষণে দেখা দেয় না । মনে হয় যেন কালও যেখানে ছিলুম। আজও সেখানেই আছি । মন দিতে চাই, মন ঘুরে বেড়ায় ; হৃদয়কে ডাকাডাকি কবি, হৃদয় সাড়া দেয় না | কেবলই মনে হয় বার্থ উপাসনার চেষ্টায় ক্লিষ্ট হচ্ছি। ! কিন্তু সেই ব্যর্থ উপাসনার ভয়ানক ভার বহন করে নিষ্ঠ প্ৰত্যেক দিনই চলতে পারে- দিনের পর দিন, দিনের পর দিন । অগ্রসর হচ্ছেই, অগ্রসর হচ্ছেই। — প্রতিদিন যে গমস্থানের কিছু কিছু করে কাছে আসছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। ঐ দেখে হঠাৎ একদিন কোথা হতে ভক্তির ওয়েসিস দেখা দেয়- সুদূরপ্রসারিত দগ্ধ পাণ্ডুরতার মধ্যে মধুফলগুচ্ছপর্ণ খর্জীবকুঞ্জের সুস্নিগ্ধ শ্যামলতা ! সেই নিভৃত ছায়াতলে শীতল জলের উৎস বয়ে যাচ্ছে । সেই জল পান করে তাতে স্নান করে ছায়ায় বিশ্রাম করে আবার পথে যাত্রা করি। কিন্তু ভক্তির সেই মধুরতা সেই শীতল সরসতা তো বরাবর সঙ্গে সঙ্গে চলে না । তখন আবার সেই কঠিন শুষ্ক অশ্রান্ত নিষ্ঠ । তার একটি গুণ আছে, ভক্তির জল যদি সে কোনো সযোগে একদিন পান করতে পায় তবে সে অনেকদিন পর্যন্ত তাকে ভিতরের গোপন আধারে জমিয়ে রাখতে পারে । ঘোরতর নীরসন্তার দিনেও সেই তার পিপাসার সম্বল 1 । সাধনায় যাকে পাওয়া যায় তার প্রতি ভক্তিকেই আমরা ভক্তি বলি, কিন্তু নিষ্ঠা হচ্ছে সাধনারই প্রতি ভক্তি । এই কঠোর কঠিন শুষ্ক সাধনাই হচ্ছে নিষ্ঠার প্রাণের ধন । এতে তার একটি গভীরতর আনন্দই