পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন W9N (? আছে। সে একটি অহেতুক পবিত্র আনন্দ | এই বজ্ৰসাের আনন্দে সে নৈরাশাকে দূরে রেখে দেয়— সে মৃত্যুকেও ভয় করে না । এই আমাদের মরুপথের একমাত্র সঙ্গিনী নিষ্ঠা যেদিন পথের অন্তে এসে পৌছোয় সেদিন সে ভক্তির হাতে আমাদের সম্পূর্ণ সমৰ্পণ করে দিয়ে নিজেকে তার দাসীশালায় লুকিয়ে রেখে দেয় ; কোনো অহংকার করে না, কোনো দাবি করে না- সার্থকতার দিনে আপনাকে অন্তরালে প্রচ্ছন্ন -করেই তার সুখ । ১৭ ফাল্পন নিষ্ঠার কাজ নিষ্ঠ যে কেবল আমাদের শুষ্ক কঠিন পথের উপর দিয়ে অক্লান্ত অধ্যাবসায়ে চালন করে নিয়ে যায় তা নয়, সে আমাদের কেবলই সতর্ক করে দেয় ; রোজই একভাবে চলতে চলতে আমাদের শৈথিলী এবং অমনোযোগ আসতে থাকে | নিষ্ঠা কখনো ভুলতে চায় না— সে আমাদের ঠেলে দিয়ে বলে এ কী হচ্ছে ! এ কী করছ । সে মনে করিয়ে দেয় ঠাণ্ডার সময় যদি এগিয়ে না থাক তবে রৌদ্রের সময় যে কষ্ট পাবে । সে দেখিয়ে দেয় তোমার জলাধারের ছিদ্র দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছে, পিপাসার সময় উপায় द शुल ! আমরা সমস্ত দিন কতরকম করে যে শক্তির অপব্যয় করে চলি তার ঠিকানা নেই– কত বাজে কথায়, কত বাজে কাজে । নিষ্ঠা হঠাৎ স্মরণ করিয়ে দেয়, “এই যে-জিনিসটা এমন করে ফেলাছড়া করছি এটার যে খুব প্রয়োজন আছে। একটু চুপ করো, একটু স্থির হও, অত বাড়িয়ে বোলো না, অমন মাত্রা ছাড়িয়ে চোলো না, যে জল পান করবার জন্যে যত্নে সঞ্চিত করা দরকার সে জলে খামকা পা ডুবিয়ে বােসো না ।" আমরা যখন খুব আত্মবিস্মৃত হয়ে একটা তুচ্ছতার ভিতরে একেবারে গলা পর্যন্ত নেবে গিয়েছি তখনো সে আমাদের ভোলে না— বলে, “ছি, এ কী কাণ্ড !" বুকের কাছেই সে বসে আছে, কিছুই তার দৃষ্টি এড়াতে চায় না । সিদ্ধিলাভের কাছাকাছি গেলে প্রেমের সহজ প্ৰজ্ঞতা লাভ হয়, তখন মাত্রাবোধ আপনি ঘটে । সহজ কবি যেমন সহজেই ছন্দোরক্ষা করে চলে আমরা তেমনি সহজেই জীবনকে আগাগোড়া সৌন্দর্যের মধ্যে বিশুদ্ধরূপে নিয়মিত করতে পারি। তখন স্বলন হওয়াই শক্ত হয়। কিন্তু রিক্ততার দিনে সেই আনন্দের সহজ শক্তি যখন থাকে না, তখন পদে পদে যাতিপতন হয় ; যেখানে থামবার নয় সেখানে আলস্যা করি, যেখানে থামবার সেখানে বেগ সামলাতে পারি নে। তখন এই কঠোর নিষ্ঠাই আমাদের একমাত্ৰ সহায় । তার ঘুম নেই, সে জেগেই আছে । সে বলে, “ও কী ! ঐ যে একটা রাগের রক্ত আভা দেখা দিল । ঐ যে নিজেকে একটু বেশি করে বাড়িয়ে দেখবার জন্যে তোমার চেষ্টা আছে। ঐ যে শত্রুতার কাটা তোমার স্মৃতিতে বিধেই রইল। কেন, হঠাৎ গোপনে তোমার এত ক্ষোভ দেখি কেন । এই যে রাত্রে শুতে যােচ্ছ, এই পবিত্র নির্মল নিদ্রার কক্ষে প্রবেশ করতে যাবার মতো শান্তি তোমার অন্তরে কোথায় !" সাধনার দিনে নিষ্ঠার এই নিতা সতর্কতার স্পৰ্শই আমাদের সকলের চেয়ে প্রধান আনন্দ। এই নিষ্ঠা যে জেগে আছেন এইটে যতই জানতে পাই ততই বক্ষের মধ্যে নির্ভর অনুভব করি। যদি কোনােদিন কোনো আত্মবিস্মৃতির দুর্যোগে এঁর দেখা না পাই তবেই বিপদ গনি। যখন চরম সুহৃদকে না। পাই তখন এই নিষ্ঠাই আমাদের পরম সুহৃদরূপে থাকেন। তার কঠোর মূর্তি প্রতিদিন আমাদের কাছে শুভ্ৰ সৌন্দর্যে মণ্ডিত হয়ে ওঠে । এই চাঞ্চল্যবর্জিত ভোগবিরত পুণ্যশ্ৰী তাপসিনী আমাদের রিক্ততার মধ্যে শক্তি শান্তি এবং জ্যোতি বিকীর্ণ করে দারিদ্র্যকে রমণীয় করে তোলেন ।