পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন УSR উপাসনা হয় না, তখন উপাসনা যে কাকে বলে তা বুঝতে বাকি থাকে না । কেবল ঈশ্বরের উপাসনাটাই হচ্ছে উপাসনার মধ্যে সব চেয়ে ফাকি । এর মানে আর কিছুই নয়, নিজের অংশটাকেই সব চেয়ে বড়ো করে ঘের দিয়ে নিয়ে ঈশ্বরকে এক পাই অংশের শরিক করি এবং মনে করি আমার সকল দিক রক্ষা হল । আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে “যা দ্বয়লোকসাধনী তনুভূতাং সা চাতুরী চাতুরী”- যাতে দুই লোকেরই সাধনা হয় মানুষের সেই চাতুরীই চাতুরী। কিন্তু যে-চাতুরী দুইলোক রক্ষার ভার নেয় শেষকালে সে ঐ দুই লোকের মধ্যে একটা লোকের কথা ভুলতে থাকে, তার চাতুরী ঘুচে যায়। যে-লোকটি আমার দিকের লোক অধিকাংশ স্থলে সেই দিকের সীমানাই অজ্ঞাতসারে এবং জ্ঞাতসারে বেড়ে চলতে থাকে । ঈশ্বরের জন্যে ঐ যে এক পাই জমি রেখেছিলুম, যদি তাতে কোনো পদার্থ থাকে, যদি সেটা নিতান্তই বালিচাপা মরুভূমি না হয়, তবে একটু একটু করে লাঙল ঠেলে ঠেলে সেটা আত্মসাৎ করে নেবার চেষ্টা করি। “আমি” জিনিসটা যে একটা মস্ত পাথর, তার ভার যে ভয়ানক ভার। যে দিকটাতে সেই আমিটাকেই চাপাই সেই দিকটাতেই যে ধীরে ধীরে সমস্তটাই কত হয়ে পড়তে চায়। যদি রক্ষা পেতে চাও, তবে ঐটিকেই একেবারে জলের মধ্যে ফেলে দিতে পারলেই ভালো হয় | আসল কথা, সবটাই যদি ঈশ্বরকে দিতে পারি তা হলেই দুই লোক রক্ষা হয়-চাতুরী করতে গেলে হয় না। তার মধ্যেই দুই লোক আছে। তার মধ্যেই যদি আমাকে পাই তবে একসঙ্গেই তাকেও পাই আমাকেও পাই। আর তার সঙ্গে যদি ভাগ বিভাগ করে সীমানা টেনে পাকা দলিল করে নিয়ে কাজ চালাতে চাই তা হলে সেটা একেবারেই পাকা কাজ হয় না, সেটা বিষয়কমের নামান্তর হয় | বিষয়কর্মের যে গতি তারও সেই গতি- অর্থাৎ তার মধ্যে নিত্যতার লক্ষণ নেই- তার মধ্যে বিকার আসে এবং ক্রমে মৃত্যু দেখা দেয় । ও-সমস্ত চাতুরী ছেড়ে দিয়ে ঈশ্বরকে সম্পূর্ণই আত্মসমৰ্পণ কতে হবে এই কথাটাকেই পাকা করা যাক । আমার দুইয়ে কাজ নেই, আমার একই ভালো। আমার অন্তরাত্মার মধ্যে একটি সতীর লক্ষণ আছে, সে চতুরা নয়, সে যথার্থই দুইকে চায় না, সে এককেই চায় ; যখন সে এককে পায় তখনই সে সমস্তকেই পায় । । একাগ্র হয়ে সেই একের সাধনাই করব কিন্তু কঠিন সংকট এই যে, আজ পর্যন্ত সেজন্যে কোনো আয়োজন করা হয় নি। সেই পরামকে বাদ দিয়েই সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। জীবন এমনি ভাবে তৈরি হয়ে গেছে যে, কোনোমতে ঠেলে ঠেলে তাকে জায়গা করে, দেওয়া একেবারে অসম্ভব হয়ে dՇ(շ | পৃথিবীতে আর সমস্তই গীেজামিলন দেওয়া যায়, যেখানে পাঁচজনের বন্দােবস্ত সেখানে ছজনকে ঢুকিয়ে দেওয়া খুব বেশি শক্ত নয়, কিন্তু তার সম্বন্ধে সেরকম গীেজামিলন চালাতে গেলে একেবারেই চলে না। তিনি “পুনশ্চ নিবেদনের" সামগ্ৰী নন। তার কথা যদি গােড়া থেকে ভুলেই থাকি, তবে গোড়াগুড়ি সে ভুলটা সংশোধন না করে নিলে উপায় নেই | যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে এখন আমনি একরকম করে কাজ সেরে নেও, এ কথা তার সম্বন্ধে কোনোমতেই খাটবে না । ঈশ্বরবিবর্জিত যে জীবনটা গড়ে তুলেছি তার আকর্ষণ যে কত প্রবল তা তখনই বুঝতে পারি যখন ঠার দিকে যেতে চাই। যখন তার মধ্যেই বসে আছি তখন সে যে আমাকে বেঁধেছে তা বুঝতেই পারি নে। কিন্তু প্রত্যেক অভ্যাস প্রত্যেক সংস্কারটিই কী কঠিন গ্ৰন্থি । জ্ঞানে তাকে যতই তুচ্ছ বলে জানি নে কেন, কাজে তাকে ছাড়াতে পারি নে। একটা ছাড়ে তো দেখতে পাই তার পিছনে আরো পাঁচটা আছে । সংসারকে চরম আশ্রয় বলে জেনে এতদিন বহু যত্নে দিনে দিনে একটি একটি করে অনেক জিনিস সংগ্রহ করেছি— তাদের প্রত্যেকটির ফাঁকে ফাঁকে আমার কত শিকড় জড়িয়ে গেছে তার ঠিকানা নেই- তারা সবাই আমার । তাদের কোনোটাকেই একটুমাত্র স্থানচ্যুত করতে গেলেই মনে হয় তবে