পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VS) রবীন্দ্র-রচনাবলী যে ব্যক্তি ভোগী সে অহংকেই সমস্ত পূজা জোগায়, সে চিরজীবন এই অহং-এর মুখ তাকিয়ে খেটে মরে। মৃত্যুর সময় তার সেই ভোগান্ধীত ক্ষুধার্ত অহং কপালে হাত দিয়ে বলে, “সমস্তই রইল পড়ে, কিছুই নিয়ে যেতে পারলুম না।” মৃত্যুর কথা চিন্তা করে এই অহংটাকেই যদি চিরন্তন বলে না জানি তা হলেই যথেষ্ট হল নাকারণ, সেরকম বৈরাগ্যে কেবল শূন্যতাই আনে। সেসঙ্গে এও জানতে হবে যে এই সংসারটা থাকবে। অতএব আমার যা-কিছু দেবার তা শূন্যের মধ্যে ত্যাগরিপে দেব না, সংসারের মধ্যে দানরূপে দিতে হবে। এই দানের দ্বারাই আত্মার ঐশ্বৰ্য প্রকাশ হবে, ত্যাগের দ্বারা নয়— আত্মা নিজে কিছু নিতে চায় না, সে দিতে চায়, এতেই তার মহত্ত্ব । সংসার তার দানের ক্ষেত্র এবং অহং তার দানের সামগ্ৰী । ভগবান এই সংসারের মাঝখানে থেকে নিজেকে কেবলই দিচ্ছেন, তিনি নিজের জন্যে কিছুই নিচ্ছেন না। আমাদের আত্মাও যদি ভগবানের সেই প্রকৃতিকে পায় তবে সত্যকে লাভ করে। সেও সংসারের মাঝখানে ভগবানের পাশে তার সখ্যারূপে দাড়িয়ে নিজেকে সংসারের জন্য উৎসর্গ করবে, নিজের ভোগের জন্যে লালায়িত হয়ে সমস্তই নিজের দিকে টানবে না। এই দেবার দিকেই অমৃত, নেবার দিকেই মৃত্যু। টাকাকড়ি শক্তি-সামৰ্থ্য সমস্তই সত্য যদি তা দান করি— যদি তা নিজে নিতে চাই তো সমস্তই মিথ্যা । সেই কথাটা যখন ভুলি তখন সমস্তই উলট-পালটা হয়ে যায়— তখনই শোক দুঃখ ভয়, তখনই কাম ক্ৰোধ লোভ । তখনই, স্রোতের মুখে যে নীেকা আমাকেই বহন করে নিয়ে যেত, উজানে তাকে প্ৰাণপণে বহন করবার জন্য আমাকেই ঠেলা ঠেলি টানাটানি করে মরতে হয়। যে জিনিস স্বভাবতই দেবার তাকে নেবার চেষ্টা করার এই পুরস্কার। যখন মনে করি যে নিজে নিচ্ছি তখন দিই সেটা মৃত্যুকে- এবং সেইসঙ্গে শোক চিন্তা ভয় প্রভৃতি মৃত্যুর অনুচরকে তাদের খোরাকিস্বরূপ হৃদয়ের রক্ত জোগাতে থাকি । r 8瓦面1 তরী বোঝাই “সোনার তরী" বলে একটা কবিতা লিখেছিলুম, এই উপলক্ষে তার একটা মানে বলা যেতে পারে। মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে। তার জীবনের খেতটুকু দ্বীপের মতো, চারি দিকেই অব্যাক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত, ঐ একটুখানিই তার কাছে বাক্ত হয়ে আছে। সেইজন্যে গীতা বলেছেন অব্যাক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত । অব্যাক্তনিধনানোবা তত্ৰ কা পরিদেবনা ৷ যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারিদিকের জল বেড়ে উঠছে, যখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ঐ চরটুকু তলিয়ে যাবার সময় হল— তখন তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা-কিছু নিত্য ফল তা সে ঐ সংসারের তরণীতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবে না। কিন্তু যখন মানুষ বলে ঐসঙ্গে আমাকেও নাও- আমাকেও রাখো, তখন সংসার বলে- তোমার জন্যে জায়গা কোথায় ? তোমাকে নিয়ে আমার হবে কী ? তোমার জীবনের ফসল যা-কিছু রাখবার তা সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি তো রাখবার যোগ্য নও । প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু-না-কিছু দান করছে, সংসার তার সমস্তই গ্ৰহণ করছে, রক্ষা করছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না- কিন্তু মানুষ যখন সেইসঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। এই যে জীবনটি ভোগ করা গেল, অহংটিকেই তার খাজনাস্বরূপ মত্যুর হাতে দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে । ওটি কোনোমতেই জমাবার জিনিস নয়। -, R , f