পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন V8S আত্মা বেগ পায় তার চেয়ে অধিক বাধায় আত্মা অবরুদ্ধ হয়। তখন উপকূল নদীর সামগ্ৰী না হয়ে নদীই উপকূলের সামগ্ৰী হয়ে ওঠে এবং আত্মাই অহং-এর বশীভূত হয়ে নিজের অমরত্ব ভুলে সংসারে নিতান্ত দীনহীন হয়ে বাস করতে থাকে। নিজেকে দানের দ্বারা যে সার্থক হত, সঞ্চায়ের বহুতর শুষ্কবালুময় বেষ্টনের মধ্যে সে মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকে। তবু মরে না, কেবল নিজের দুৰ্গতিকেই ভোগ করে । q (5) আত্মার প্রকাশ প্রকাশ এবং যার প্রকাশ উভয়ের মধ্যে একটি বৈপরীত্য থাকে, সেই বৈপরীত্যের সামঞ্জস্যের দ্বারাই উভয়ে সার্থকতা লাভ করে । বস্তুত বিরোধের মিলন ছাড়া প্রকাশ হতেই পারে না । কর্মের মধ্যে শক্তির একটি বাধা আছে- সেই বাধাকে অতিক্রম করে কর্মের সঙ্গে সংগত হয় বলেই শক্তিকে শক্তি বলি । কর্মের মধ্যে শক্তির সেই বিরোধ যদি না থাকত তা হলে শক্তিকে শক্তিই বলতুম না। আবার, যদি কেবল বিরোধই থাকত, তার কোনো সামঞ্জস্যই না থাকত, তা হলেও শক্তিকে শক্তি বলা যেত না । জগতের মধ্যে জগদীশ্বরের যে প্রকাশ সে হচ্ছে সীমার মধ্যে অসীমের প্রকাশ । এই সীমায় অসীমে বৈপরীত্য আছে, তা না হলে অসীমের প্রকাশ হতে পারত না । কিন্তু কেবলই যদি বৈপরীত্যই থাকত তা হলেও সীমা অসীমকে আচ্ছন্ন করেই থাকত । এক জায়গায় সীমার সঙ্গে অসীমের সামঞ্জস্য আছে। সে কোথায় ? যেখানে সীমা আপনার সীমার মধ্যেই স্থির হয়ে বসে নেই, যেখানে সে অহরহই অসীমের দিকে চলেছে। সেই চলায় তার শেষ নেই, সেই চলায় সে অসীমকে প্রকাশ করছে। মনে করো একটি বৃহৎ দৈর্ঘ্য স্থির হয়ে রয়েছে, ছােটাে মাপকাঠি কী করে সেই দৈর্ঘ্যের বৃহত্ত্বকে প্রকাশ করে | না, ক্রমাগতই সেই স্তব্ধ দৈর্ঘ্যের পাশে পাশে চঞ্চল হয়ে অগ্রসর হতে হতে । সে প্রত্যেকবার অগ্রসর হয়ে বলে, না, এখনো শেষ হল না । সে যদি চুপ করে পড়ে থাকত তা হলে বৃহত্ত্বর সঙ্গে কেবলমাত্র নিজের বৈপরীতটুকুই জানত, কিন্তু সে নাকি চলেছে, এই চলার দ্বারাই। বৃহত্ত্বকে পদে পদে উপলব্ধি করে চলেছে। এই চলার দ্বারা মাপকাঠি ক্ষুদ্র হয়েও বৃহত্ত্বকে প্রচার করছে। এইরূপে ক্ষুদ্র বৃহতে বৈপরীত্যের মধ্যে যেখানে একটা সামঞ্জস্য ঘটছে সেইখানেই ক্ষুদ্রের দ্বারা বৃহতের প্রকাশ হচ্ছে। জগৎও তেমনি সীমাবদ্ধভাবে কেবল স্থির নিশ্চল নয়— তার মধ্যে নিরস্তর একটি অভিব্যক্তি আছে, একটি গতি আছে। রূপ হতে রূপান্তরে চলতে-চলতে সে ক্রমাগতই বলছে, “আমার সীমা দ্বারা তীর প্রকাশকে শেষ করতে পারলুম না।” এইরূপে রূপের দ্বারা জগৎ সীমাবদ্ধ হয়ে গতির দ্বারা অসীমকে প্রকাশ করছে। রূপের সীমাটি না থাকলে তার গতিও থাকতে পারত না, তার গতি না থাকলে অসীম তো অব্যক্ত হয়েই থাকতেন । আত্মার প্রকাশরািপ যে অহং, তার সঙ্গে আত্মার একটি বৈপরীত্য আছে। আত্মান জায়তে ত্ৰিয়তে । না জন্মায় নামরে। অহং জন্মমরণের মধ্যে দিয়ে চলেছে। আত্মা দান করে, অহং সংগ্রহ করে। আত্মা অনন্তের মধ্যে সঞ্চারণ করতে চায়, অহং বিষয়ের মধ্যে আসক্ত হতে থাকে। এই বৈপরীত্যের বিরোধের মধ্যে যদি একটি সামঞ্জস্য স্থাপিত না হয় তবে অহং আত্মাকে প্রকাশনা করে তাকে আচ্ছন্নই করবে । ং আপনার মৃত্যুর দ্বারাই আত্মার অমরত্ব প্রকাশ করে। কােনাে সীমাবদ্ধ পদার্থ নিশ্চল হয়ে এই