পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\98 პა. রবীন্দ্র-রচনাবলী অমর আত্মাকে নিজের মধ্যে একভাবে রুদ্ধ করে রাখতে পারে না | অহং-এর মৃত্যুর দ্বারা আত্মা রূপকে বর্জন করতে-করতেই নিজের রূপান্তীত স্বরূপকে প্রকাশ করে । রূপ কেবলই বলে, “একে আমি বঁধতে পারলুম না, এ আমাকে নিরস্তুর ছাড়িয়ে চলছে।” এই জন্মমৃত্যুর দ্বারগুলি আত্মার পক্ষে রুদ্ধ দ্বার নয় । সে যেন তার রাজপথের বিজয় তোরণের মতো, তার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে-করতে সে চলে যাচ্ছে, এগুলি কেবল তার গতির পরিমাপ করছে মাত্র | অহং নিয়ত চঞ্চল হয়ে আত্মাকে কেবল মাপছে আর কেবলই বলছে— ‘না, একে আমি সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারলুম না । সে যেমন সব জিনিসকেই বদ্ধ করে রাখতে চায় তেমনি আত্মাকেও সে বাধতে চায় । বদ্ধ করতে চাওয়াই তার ধর্ম। অথচ একেবারে বদ্ধ করে রাখা তার ক্ষমতার মধ্যে নেই । যেমন বদ্ধ করা তার প্রবৃত্তি, তেমনি বদ্ধ করাই যদি তার ক্ষমতা হত। তবে আমন সর্বনেশে জিনিস আর কী হত । তাই বলছিলুম অহং আত্মাকে যে কেবলই বাঁধছে এবং ছেড়ে দিচ্ছে, সেই বাধা এবং ছেড়ে দেওয়ার দ্বারাই সে আত্মার মুক্ত-স্বভাবকে প্রকাশ করছে। যদি না বাধত তা হলে এই মুক্তির প্রকাশ কোথায় থাকত ? যদি না ছেড়ে দিত তা হলেই বা কোথায় থাকত ? আত্মা দান করে এবং অহং সংগ্রহ করে, এই বৈপরীত্যের মধ্যে সামঞ্জস্য কোথায় সে কথার আলোচনা কাল করেছি | আত্মা দান করবে বলেই অহং সংগ্রহ করে, এইটেই হচ্ছে ওর সামঞ্জস । অহং সে কথা ভোলে- সে মনে করে সংগ্রহ করা ভোগেরই জন্যে । এই মিথ্যাকে যতই সে আঁকড়ে ধরতে চায় এই মিথ্যা ততই তাকে দুঃখ দেয়, ফাকি দেয়। আত্মা তার অহংবৃক্ষে ফল ফলাবে বটে, কিন্তু ফল আত্মসাৎ করবে না, দান করবে । আমাদের জীবনের সাধনা এই যে, অহং-এর দ্বারা আমরা আত্মাকে প্রকাশ করব । যখন তা না করে ধনকে মানকে বিদ্যাকেই প্রকাশ করতে চাই তখন অহং নিজেকেই প্ৰকাশ করে, আত্মাকে প্রকাশ করে না । তখন ভাষা নিজের বাহাদুরি দেখাতে চায়, ভাব স্নান হয়ে যায় । যারা সাধুপুরুষ তাদের অহং চোখেই পড়ে না, তাদের আত্মাকেই দেখি । সেইজন্যে তাদের মহাধনী জীবন সার্থক । তাদের অহং আত্মাকে মুক্তই করছে, বাধাগ্ৰস্ত করছে না । এইজন্যেই আমাদের প্রার্থনা যে, আমরা যেন এই মানবজীবনে সত্যকেই প্ৰকাশ করি, অসতাকে নিয়েই দিনরাত ব্যস্ত হয়ে না থাকি । আমরা যেন প্রবৃত্তির অন্ধকারের মধ্যেই আত্মাকে আচ্ছন্ন করে না রাখি, আত্মা যেন এই ঘোর অন্ধকারে আপনাকে আপনি না হারায়, মোহমুক্ত নির্মল জ্যোতিতে আপনাকে আপনি উপলব্ধি করে, সে যেন নানা অনিত্য উপকরণের সঞ্চায়ের মধ্যে পদে পদে আঘাত খেতে খেতে হাতড়ে না বেড়ায়, সে যেন আপনার অমৃতরূপকে আনন্দ রূপকে তোমার মধ্যে লাভ করে | হে স্বপ্ৰকাশ, আত্মা যেন নিজের সকল প্রকাশের মধ্যে তোমাকেই প্ৰকাশ করে- নিজের অহংকেই প্ৰকাশ না করে, মানবজীবনকে একেবারে নিরর্থক করে না দেয় । r u আদেশ কোন কোন মন্দ কাজ করবে না। তার বিশেষ উল্লেখ করে সেইগুলিকে ধর্মশাস্ত্ৰ ঈশ্বরের বিশেষ নিষেধরূপে প্রচার করেছেন । সেরকম ভাবে প্রচার করলে মনে হয় যেন ঈশ্বর কতকগুলি নিজের ইচ্ছামত আইন করে দিয়েছেন, সেই আইনগুলি লঙঘন করলে বিশ্বরাজের কোপে পড়তে হবে । সে কথাটাকে এইরূপ ক্ষুদ্র ও কৃত্রিম -ভাবে মানতে পারি নে। তিনি কোনো বিশেষ আদেশ জানান নি, কেবল তার একটি আদেশ তিনি ঘোষণা করেছেন, সমস্ত বিশ্ব-ব্ৰহ্মাণ্ডের উপরে তার সেই আদেশ- সেই একমাত্র আদেশ |