পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Ꮤ28 ᏭᏯ তিনি কেবলমাত্র বলেছেন, প্রকাশিত হও । সূর্যকেও তাই বলেছেন, পৃথিবীকেও তাই বলেছেন, মানুষকেও তাই বলেছেন। সূর্য তাই জ্যোতির্ময় হয়েছে, পৃথিবী তাই জীবধাত্রী হয়েছে, মানুষকেও তাই আত্মাকে প্রকাশ করতে হবে । বিশ্বজগতের যে-কোনো প্রান্তে তীর এই আদেশ বাধা পাচ্ছে, সেইখানেই কুঁড়ি মুষড়ে যাচ্ছে, সেইখনেই নদী ম্রোতােহীন হয়ে শৈবালজালে রুদ্ধ হচ্ছে— সেইখানেই বন্ধন, বিকার, বিনাশ । বুদ্ধদেব যখন বেদনাপূর্ণ চিত্তে ধান-দ্বারা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন যে, মানুষের বন্ধন বিকার বিনাশ কেন, দুঃখ জরা মৃত্যু কেন, তখন তিনি কোন উত্তর পেয়ে আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন ? তখন তিনি এই উত্তরই পেয়েছিলেন যে, মানুষ আত্মাকে উপলব্ধি করলেই, আত্মাকে প্রকাশ করলেই মুক্তিলাভ করবে। সেই প্রকাশের বাধাতেই তার দুঃখ— সেইখানেই তার পাপ । এইজন্যে তিনি প্রথমে কতকগুলি নিষেধ স্বীকার করিয়ে মানুষকে শীল গ্রহণ করতে আদেশ করেন। তাকে বললেন, “তুমি লোভ কোরো না, হিংসা কোরো না, বিলাসে আসক্ত হােয়ে না।” যে-সমস্ত আবরণ তাকে বেষ্টন করে ধরেছে সেইগুলি প্রতিদিনের নিয়ত অভ্যাসে মোচন করে ফেলবার জন্যে তাকে উপদেশ দিলেন। সেই আবরণগুলি মােচন হলেই আত্মা আপনার বিশুদ্ধ স্বরূপটি লাভ করবে । সেই স্বরূপটি কী ? শূন্যতা নয়, নৈষ্কর্ম নয়। সে হচ্ছে মৈত্রী, করুণ, নিখিলের প্রতি প্ৰেম । বুদ্ধ কেবল বাসনা ত্যাগ করতে বলেন নি, তিনি প্রেমকে বিস্তার করতে বলেছেন। কারণ এই প্রেমকে বিস্তারের দ্বারাই আত্মা আপন স্বরূপকে পায়- সূর্য যেমন আলোককে বিকীর্ণ করার দ্বারাই আপনার স্বভাবকে পায় । সর্বলোকে আপনাকে পরিকীর্ণ করা আত্মার ধর্ম— পরমাত্মারও সেই ধর্ম। তার সেই ধর্ম পরিপূর্ণ, কেননা, তিনি শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং । তিনি নির্বিকার, তাতে পাপের কোনাে বাধা নেই। সেইজনে সর্বত্রই তার প্রবেশ । পাপের বন্ধন মােচন করলে আমাদেরও প্রবেশ অব্যাহত হবে। তখন আমরা কী হব ? পরমাত্মার মতাে সেই স্বরূপটি লাভ করব, যে স্বরূপে তিনি কবি, মনীষী, প্ৰভু, স্বয়ম্বু। আমরাও আনন্দময় কবি হব, মনের অধীশ্বর হব, দাসত্ব থেকে মুক্ত হব, আপনি নির্মল আলোকে আপনি প্রকাশিত হব | v୪୧୩ আত্মা সমস্ত চিন্তায় বাকো কর্মে আপনাকে শািন্তম শিবম অদ্বৈতম রূপে প্রকাশ করবে- আপনাকে ক্ষুব্ধ করে লুব্ধ করে খণ্ডবিখণ্ডিত করে দেখাবে না। মৈত্রেয়ীর প্রার্থনাও সেই প্রকাশের প্রার্থনা | যে প্রার্থনা বিশ্বের সমস্ত কুঁড়ির মধ্যে, কিশলয়ের মধ্যে, যে প্রার্থনা দেশকালের অপরিতৃপ্ত গভীরতার মধ্য হতে নিয়ত উঠছে, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের প্রত্যেক অণুতে পরমাণুতে যে প্রার্থনা, যে প্রার্থনার যুগ-যুগান্তর-ব্যাপী ক্ৰন্দনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলেই বেদে এই অন্তরক্ষকে ক্ৰন্দসী রোদসী বলেছে, সেই মানবাত্মার চিরন্তন প্রার্থনাই মৈত্রেয়ীর প্রার্থনা। আমাকে প্রকাশ করো, আমাকে প্রকাশ করো | আমি অসত্যে আচ্ছন্ন, আমাকে সত্যে প্রকাশ করো। প্রকাশ করো। হে আবিঃ, হে পরিপূর্ণ প্রকাশ, তােমার মধ্যেই আমার প্রকাশ হােক, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ কোনাে বাধা না পাক- সেই প্রকাশ নির্মুক্ত হলেই তোমার দক্ষিণ মুখের জ্যোতিতে আমি চিরকালের জন্যে রক্ষা পাব । সেই প্রকাশের বাধাতেই তোমার অপ্ৰসন্নতা। বুদ্ধ সমস্ত মানবের হয়ে নিজের জীবনে এই পরিপূর্ণ প্রকাশের প্রার্থনাই করেছিলেন– এ ছাড়া মানুষের আর দ্বিতীয় কোনাে প্রার্থনাই নেই। 沁瓦西