পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve( INR রবীন্দ্র-রচনাবলী অতএব আমরা যতই ভুল করি, যাই করি, কেবলমাত্র ব্যাকরণশিক্ষার কথা মানতে পারব না। কেবল পাঠশালায় শিক্ষকের কাছেই শিখব, এ চলবে না, মায়ের কাছেও শিক্ষা পাব। মায়ের কাছে যা পাই তার মধ্যে অনেক শক্ত নিয়ম অজ্ঞাতসারে আপনি অন্তঃসাৎ হয়ে থাকে, সেই সুযোগটুকু কি ছাড়া যায় ? পক্ষিশাবককে একদিন চরে খেতে হবে সন্দেহ নেই, একদিন তাকে নিজের ডানা বিস্তার করে উড়তে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে মার মুখ থেকে সে খাবার খায়। যদি তাকে বলি, যে পর্যন্ত না চলে খাবার শক্তি সম্পূর্ণ হবে সে পর্যন্ত খেতেই পাবে না, তা হলে সে যে শুকিয়ে মরে যাবে। আমরা যতদিন অশক্ত আছি ততদিন যেমন অল্প অল্প করে শক্তির চর্চা করব, তেমনি প্রতিদিন ঈশ্বরের প্রসাদের জন্যে ক্ষুধিত চঞ্চপুট মেলতে হবে ; তার কাছ থেকে সহজ কৃপার দৈনিক খাদ্যটুকু পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে কলরব করতে হবে । এ ছাড়া উপায় দেখি নে । এখন তো অনন্তে ওড়বার ডানা পাকা হয় নি, এখন তো নীড়েই পড়ে আছি। ছোটােখাটাে কুটােকাটা দিয়ে যে সামান্য বাসা তৈরি হয়েছে এই আমার আশ্রয়। এই আশ্রয়ের মধ্যে বদ্ধ থেকেই অনন্ত আকাশ হতে আহরিত খাদ্যের প্রত্যাশা। যদি আমাদের একেবারেই ছেড়ে দিতে হয়, তা হলে আমাদের কী দশা হবে ? তুমি বলতে পারো, “ঐ খাদ্যের দিকেই যদি তুমি তাকিয়ে থাক তা হলে চিরদিন নিশ্চেষ্ট হয়েই থাকবে, নিজের শক্তির পরিচয় পাবে না । সে শক্তিকে যে একেবারে চালনা করব না। সে কথা বলি নে। ওড়বার প্রয়াসে দুর্বল পািখ অনুকর তাকেশন্ত করে তুলতে হবে । কিন্তু কৃপার খাদ্যটুকু, প্রেমের পুষ্টিটুকু, প্রতিদিনই সঙ্গে मात्रा bाश् | সেটি যদি নিয়মিত লাভ করি তা হলে যখনই পুরোপুরি বল পাব তখন নীড়ে ধরে রাখে এমন সাধ । কার ? দ্বিজশাবকের স্বাভাবিক ধর্মই যে অনন্ত আকাশে ওড়া। তখন নিজের প্রকৃতির গরজেই, সে । সংসারনীড়ে বাস করবে বটে, কিন্তু অনন্ত আকাশে বিহার করবে । এখন সে অক্ষম ডানটি নিয়ে বাসায় পড়ে পড়ে কল্পনাও করতে পারে না যে, আকাশে ওড়া সম্ভব। তার যে শক্তিটুকু আছে সেইটুকুকে অনেক পরিমাণে বাড়িয়ে দেখলেও সে কেবল ডালে ডালে লাফাবার কথাই মনে করতে পারে । সে যখন তার কোনো প্ৰবীণ সহােদরের কাছে আকাশে উধাও হবার কথা শোনে তখন সে মনে করে দাদা একটা অত্যুক্তি প্রয়োগ করছেন— যা বলছেন তার ঠিক মানে কখনোই এ নয় যে সত্যিই আকাশে ওড়া। ঐ যে লাফাতে গেলে মাটির সংস্রব ছেড়ে যেটুকু নিরাধার উর্ধের্ব উঠতে হয়। সেই ওঠাটুকুকেই তারা আকাশে ওড়া বলে প্রকাশ করছেন— ওটা কবিত্বমাত্র, ওর মানে কখনোই এতটা হতে পারে না । বস্তুত এই সংসারনীড়ের মধ্যে আমরা যে অবস্থায় আছি তাতে বুদ্ধদেব যাকে ব্ৰহ্মবিহার বলেছেন, । ভগবান যিশু যাকে সম্পূর্ণতালাভ বলেছেন, তাকে কোনােমতেই সম্পূর্ণ সত্য বলে মনে করতে পারি (ନା । কিন্তু এসব আশ্চর্য কথা তাদেরই কথা যারা জেনেছেন, র্যারা পেয়েছেন । সেই আশ্বাসের আনন্দ যেন একান্ত ভক্তিভরে গ্রহণ করি । আমাদের আত্মা দ্বিজশাবক, সে আকাশে ওড়বার জন্যেই প্ৰস্তুত হচ্ছে, সেই বার্তা র্যারা দিয়েছেন তাদের প্রতি যেন শ্রদ্ধা রক্ষা করি— তাদের বাণীকে আমরা যেন খর্ব করে তার প্রাণশক্তিকে নষ্ট করবার চেষ্টা না করি । প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে যখন তার প্রসাদ সুধা চাইব সেইসঙ্গে এই কথাও বলব, ‘আমার ডানাকেও তুমি সক্ষম করে তোলো। আমি কেবল আনন্দ চাই নে, শিক্ষা চাই ; ভাব চাই নে, কর্ম চাই ।” S७ b;