পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন \\ኃó ዔ কিন্তু সমস্ত স্বভাব থেকে চুরি করে এনে তঁাকে স্বেচ্ছাপূর্বক কোনাে একটা কৃত্রিমতার মধ্যে বিশেষ করে দেখবার চেষ্টা এখনো মানুষের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। এমন-কি, কেউ কেউ স্পর্ধা করে বলেন সেইরকম করে দেখাই হচ্ছে প্রকৃষ্ট দেখা । সব রূপ হতে ছাড়িয়ে একটি কোনো বিশেষরূপে, সব মানুষ হতে সরিয়ে একটি কোনাে বিশেষ মানুষে, ঈশ্বরকে পূজা করাই তারা বলেন পূজার চরম। জানি মানুষ এরকম কৃত্রিম উপায়ে কোনো একটা হৃদয়বৃত্তিকে অতিপরিমাণে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে, কোনো একটা রসকে অত্যন্ত তীব্র করে দাড় করাতে পারে। কিন্তু সেইটো করাই কি সাধনার व्श्का ? অনেক সময় দেখা যায় অন্ধ হলে স্পর্শশক্তি অতিরিক্ত বেড়ে যায়। কিন্তু সেইরকম এক দিকের চুরির দ্বারা অন্য দিককে উপচিয়ে তোলাকেই কি বলে শক্তির সার্থকতা ? যে দিকটা নষ্ট হল সে দিকটার হিসাব কি দেখতে হবে না ? সে দিকের দণ্ড হতে কি আমরা নিষ্কৃতি পাব ? কোনোপ্রকার বাহ্য ও সংকীর্ণ উপায়ের দ্বারা সম্মোহনকে মেসমেরিজমকে ধর্মসাধনার প্রধান অঙ্গ করে তুললে আমাদের চিত্ত স্বাস্থ্য থেকে, স্বভাব থেকে, সুতরাং মঙ্গল থেকে বিচুত হবেই হবে । আমরা ওজন হারাব- আমরা যে দিকটাতে এইরকম অসংগত ঝোক দেব সেই দিকটাকেই বিপর্যন্ত করে দেব | বস্তুত স্বভাবের পরিপূর্ণতাকে লাভ করাই ধর্ম ও ধর্মনীতির শ্রেষ্ঠ লাভ। মানুষ নানা কারণে তার স্বভাবের ওজন রাখতে পারে না, সে সামঞ্জস্য হারিয়ে ফেলে- এই তো তার পাপের মূল এবং ধর্মনীতি তো এইজন্যই তাকে সংযমে প্রবৃত্ত করে। এই সংযমের কাজটা কী ? প্রবৃত্তিকে উন্মুল করা নয়, প্রবৃত্তিকে নিয়মিত করা। কোনো একটা প্রবৃত্তি যখন বিশেষরূপ প্রশ্রয় পেয়ে স্বভাবের সামঞ্জস্যকে পীড়িত করে তখনই পাপের উৎপত্তি হয়। অর্জনস্পাহা যখন অত্যন্ত উগ্র হয়ে উঠে টাকা অর্জনের দিকেই মানুষের শক্তিকে একান্ত বাধতে চায় তখনই সেটা লোভ হয়ে দাঁড়ায় । তখনই সে মানুষের চিত্তকে তার সমস্ত স্বাভাবিক দিক থেকে চুরি করে এই দিকেই জড়ো করে। এই প্রকারে স্বভাব থেকে যে-ব্যক্তি ভ্ৰষ্ট হয় সে কখনোই যথার্থ মঙ্গলকে পায় না, সুতরাং ঈশ্বরকে লাভ তার পক্ষে অসাধ্য। কোনো মানুষের প্রতি অনুরাগ যখন স্বভাব থেকে আমাদের বিচূতি করে তখনই তা কাম হয়ে ওঠে। সেই কাম আমাদের ঈশ্বরলাভের বাধা । এইজন্য সামঞ্জস্য থেকে, বিকৃতি থেকে, মানুষের চিত্তকে স্বভাবে উদ্ধার করাই হচ্ছে ধর্মনীতিব একান্ত চেষ্টা । উপনিষদে ঈশ্বরকে সর্বব্যাপী বলবার সময় যখন তাকে অপাপবিদ্ধ বলা হয়েছে তখন তার তাৎপর্য এই । তিনি স্বভাবে অবাধে পরিব্যাপ্ত | পাপ তাকে কোনো একটা বিশেষ সংকীর্ণতায় আকৃষ্ট আবদ্ধ করে অন্যত্র থেকে পরিহরণ করে নেয় না- এই গুণেই তিনি সর্বব্যাপী । আমাদের মধ্যে পাপ সমগ্রের ক্ষতি করে কোনো-একটাকেই স্ফীত করতে থাকে । তাতে করে কেবল যে নিজের স্বভাবের মধ্যে নিজের সামঞ্জস্য থাকে না তা নয়, চারি দিকের সঙ্গে সমাজের সঙ্গে আমাদের সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে राश | ধর্মনীতিতে আমরা এই যে স্বভারলাভের সাধনায় প্রবৃত্ত আছি, সমাজ এবং নীতি শাস্ত্ৰ এজন্যে দিনরাত তাড়না করছে। এইখানেই কি এর শেষ ? ঈশ্বরসাধনাতেও কি এই নিয়মের স্থান নেই ? সেখানেও কি আমরা কোনো-একটি ভাবকে কোনো-একটি রসকে সংকীর্ণ অবলম্বনের দ্বারা অতিমাত্র আন্দোলিত করে তোলাকেই মানুষের একটি চরম লাভ বলে গণ্য করব ? দুর্বলের মনে একটা উত্তেজনা জাগিয়ে তার হৃদয়কে প্রলুব্ধ করবার জন্যে এই সকল উপায়ের প্রয়োজন এমন কথা অনেকে বলেন । যে লোক মদ খেয়ে আনন্দ পায় তার সম্বন্ধে কি আমরা ঐরূপ তর্ক করতে পারি ? আমরা কি বলতে পারি। মদেই যখন ও বিশেষ আনন্দ পায় তখন ঐটেই ওর পক্ষে শ্রেয়।