পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○"の রবীন্দ্র-রচনাবলী 醚 তা নয়। বিশ্বভুবনের মধ্যে সমস্তকে পরিপূর্ণ করে তিনি আনন্দিত। জলে স্থলে আকাশে তিনি আনন্দময় । তার সেই আনন্দকে সেই প্রেমকে তিনি নিয়তই প্রেরণ করছেন, সেইজন্যেই আমি বেঁচে থেকে আনন্দিত, কাজ করে আনন্দিত, জেনে আনন্দিত, মানুষের সঙ্গে নানা সম্বন্ধে আনন্দিত। তারই প্রেমের তরঙ্গ আমাকে কেবলই স্পর্শ করছে, আঘাত করছে, সচেতন করছে। এই যে অহােরাত্র সেই ভূমীর প্রেম নানা বর্ণে গন্ধে গীতে, নানা স্নেহে সখ্যে শ্রদ্ধায়, জোয়ারের বেগের মতো আমাদের মধ্যে এসে পড়ছে, এই বোধের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যেন আমরা বলি ; ওঁ পিতা নােহসি । কেবলই তিনি প্ৰাণে ও প্রেমে আমাকে ভরে দিচ্ছেন, এই অনুভূতিটি যেন আমরা না হারাই। এই অনুভূতি যাদের কাছে অত্যন্ত উজ্জ্বল ছিল তারাই বলেছেন- কোহ্যেবানাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ । এষহােবানন্দয়াতি । কেই-বা কিছুমাত্র শরীরচেষ্টা প্ৰাণের চেষ্টা করত ? আকাশে যদি আনন্দ না থাকতেন । এই আনন্দই সকলকে আনন্দ দিচ্ছেন । さb エ ভয় ও আনন্দ ওঁ পিতা নোেহসি, এই মন্ত্রে দুটি ভাবের সামঞ্জস্য আছে। এক দিকে পিতার সঙ্গে পুত্রের সাম্য আছে, পুত্রের মধ্যে পিতা আপনাকেই প্রকাশ করেছেন । আর-এক দিকে পিতা হচ্ছেন বড়ো, পুত্র ছোটাে । এক দিকে অভেদের গৌরব, আর-এক দিকে ভেদের প্রণতি । পিতার সঙ্গে অভেদ নিয়ে আমরা আনন্দ করতে পারি, কিন্তু স্পর্ধা করতে পারি নে। আমার যেখানে সীমা আছে সেখানে আমাকে মাথা নত করতে হবে । কিন্তু এই নীতির মধ্যে অপমান নেই। কেননা তিনি কেবলমাত্র আমার বড়ো নন, তিনি আমার আপন, আমার পিতা । তিনি আমারই বড়ো, আমি তারই ছোটাে । তাকে প্ৰণাম করে আমি আমার বড়ো আমাকেই প্ৰণাম করি । এর মধ্যে বাইরের কোনো তাড়না নেই, জবরদস্তি নেই। যে বড়োর মধ্যে আমি আছি, যে বড়োর মধ্যেই পরিপূর্ণ সার্থকতা, তীকে প্ৰণাম করাই একমাত্র স্বাভাবিক প্ৰণাম । কিছু পাব বলে প্ৰণাম নয়, কিছু দেব বলে প্ৰণাম নয়, ভয়ে প্ৰণাম নয়, জোরে প্রণাম নয়। আমারই অনন্ত গৌরবের উপলব্ধির কাছে প্ৰণাম । এই প্ৰণামটির মহত্ত্ব অনুভব করেই প্রার্থনা করা হয়েছে— নমস্তেহস্তু, তোমাতে আমার নমস্কার সত্য হয়ে উঠক । তাকে “পিতা নোহসি' বলে স্বীকার করলে তার সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধের একটি পরিমাণ রক্ষা হয় । তাকে নিয়ে কেবল ভােবরসে প্ৰমত্ত হবার যে একটি উদ্ধৃঙ্খল আত্মবিস্মৃতি আছে সেটি আমাদের আক্রমণ করতে পারে না । সম্রামের দ্বারা আমাদের আনন্দ গাম্ভীর্য লাভ করে, অচাঞ্চল গৌরব প্ৰাপ্ত ठूश । প্রাচীন বেদ সমস্ত মানবসম্বন্ধের মধ্যে কেবল এই পিতার সম্বন্ধটিকেই ঈশ্বরের মধ্যে বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করেছেন । মাতার সম্বন্ধকেও সেখানে তারা স্থান দেন নি । কারণ, মাতার সম্বন্ধেও এক দিকে যেন ওজন কম আছে, এক দিকে সম্পূর্ণতার অভাব আছে। মাতা সন্তানের সুখ দেখেন, আরাম দেখেন ; তার ক্ষুধাতৃপ্তি করেন, তার শোকে সত্ত্বনা দেন, তার রোগে শুশ্রুষা করেন । এ সমস্তই সন্তানের উপস্থিত অভাবনিবৃত্তির প্রতিই লক্ষ করে। পিতার দৃষ্টি সন্তানের সমস্ত জীবনের বৃহৎক্ষেত্রে । তার সমস্ত জীবন সমগ্রভাবে সার্থক হবে এই তিনি কামনা করেন । এইজন্যই সন্তানের আরাম ও সুখই তার কাছে একান্ত নয়। এইজন্য তিনি সন্তানকে দুঃখও দেন। তাকে শাসন করেন, তাকে বঞ্চিত করেন, যাতে নিয়ম লঙ্ঘন করে ভ্ৰষ্টতা প্রাপ্ত না হয়, সে দিকে তিনি সর্বদা সতর্ক থাকেন ।