পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন \د ۹ م অর্থাৎ পিতার মধ্যে মাতার স্নেহ আছে, কিন্তু সে-স্নেহ সংকীর্ণ সীমায় বদ্ধ নয় বলেই তাকে অতি প্রকট করে দেখা যায় না এবং তাকে নিয়ে যেমন ইচ্ছা খেলা চলে না । সেইজন্যে পিতাকে নমস্কার করবার সময় বলা হয়েছে- নমঃ সম্ভব।ায় চ ময়োভাবায় চ । যিনি সুখকর তাকে নমস্কার, যিনি কল্যাণকর তীকে নমস্কার। পিতা কেবল আমাদের সুখের আয়োজন করেন না, তিনি মঙ্গলের বিধান করেন। সেইজন্যেই । সুখেও তাকে নমস্কার, দুঃখেও তাকে নমস্কার। ঐখানেই পিতার পূর্ণতা ; তিনি দুঃখ দেন। উপনিষৎ এক দিকে বলেছেন- আনন্দাদ্ধোব খদ্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। আনন্দ হতেই যা-কিছু সমস্ত জন্মেছে। আবার আর-এক দিকে বলেছেন— ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূৰ্যঃ । ইহার ভয়ে অগ্নি জ্বলছে, ইহার ভয়ে সূর্য তাপ দিচ্ছে। : তীরে আনন্দ উচ্ছঙ্খল আনন্দ নয়, তার মধ্যে একটি অমোঘ নিয়মের শাসন আছে। অনন্ত দেশে অনন্তকালে কোথাও একটি কণাও লেশমাত্ৰ ভ্ৰষ্ট হতে পারে না | সেই অমোঘ নিয়মই হচ্ছে ভয় । তার সঙ্গে কিছুমাত্র চাতুরী খাটে না, সে কোথাও কাউকে তিলমাত্র প্রশ্রয় দেয় না। যদিদং কিঞ্চি জগৎ সর্বং প্রাণ এজাতি নিঃসৃতং মহদভয়ং বজ্ৰমুদ্যতম। এই যা-কিছু জগৎ সমস্তই প্রাণ হতে নিঃসৃত হয়ে প্রাণেই কম্পিত হচ্ছে— সেই যে প্রাণ, র্যার থেকে সমস্ত উদভূত হয়েছে এবং র্যার মধ্যে সমস্তই চলছে, তিনি কী রকম ? না, তিনি উদ্যত বজের মতো মহাভয়ংকর । সেইজন্যেই তো সমস্ত চলছে- নইলে বিশ্বব্যবস্থা উন্মত্ত প্ৰলাপের মতো অতি নিদারুণ হয়ে উঠত। আমাদের পিতা যে ভয়ানাং ভয়ং ভীষণং ভীষাণানাং । এই ভয়ের দ্বারাই অনাদি কাল থেকে সর্বত্ৰ সকলের সীমা ঠিক আছে, সর্বত্ৰ সকলের পরিমাণ রক্ষা হচ্ছে। আমাদেরও যে দিকটা চলাবার দিক, কী বাক্যে, কী ব্যবহারে, সেই দিকে পিতা দাড়িয়ে আছেন মহদভয়ং বজ্ৰমুদ্যতম। সে দিকে কোনো ব্যত্যয় নেই, কোনো স্থলনের ক্ষমা নেই, কোনো পাপের নিস্কৃতি নেই। অতএব আমরা যখন বলি, “পিতা নোহসি, তার মধ্যে আদরের দাবি নেই, উন্মত্ততার প্রশ্রয় নেই। অত্যন্ত সংযত আত্মসংবৃত বিনম্র নমস্কার আছে। যে বলে “পিতা নোেহসি', সে তার সামনে ‘শাস্তোদান্ত উপরন্তন্তিতিক্ষুঃ সমাহিতঃ" হয়ে থাকে। সে নিজেকে প্রত্যেক ক্ষুদ্র অধৈৰ্য ক্ষুদ্র আত্মবিস্মৃতি থেকে রক্ষা করে চলতে থাকে | Sእ ፴bŠ নিয়ম ও মুক্তি সুখ জিনিসটা কেবল আমার, কল্যাণ জিনিসটা সমস্ত জগতের । পিতার কাছে যখন প্রার্থনা করি— যদভদ্রং তন্ন আসুব, যা ভালো তাই আমাদের দাও, তার মানে হচ্ছে সমস্ত জগতের ভালো আমাদের মধ্যে প্রেরণ করে । কারণ সেই ভালোই আমার পক্ষেও সত্য ভালো, আমার পক্ষেও নিত্য ভালো। : যা বিশ্বের ভালো তাই আমার ভালো, কারণ যিনি বিশ্বের পিতা তিনিই আমার পিতা । যেখানে কল্যাণ নিয়ে, অর্থাৎ বিশ্বের ভালো নিয়ে কথা, সেখানে অত্যন্ত কড়া নিয়ম । সেখানে উপস্থিত সুখসুবিধা কিছুই খাটে না ; সেখানে ব্যক্তিবিশেষের আরাম বিরামের স্থান নেই। সেখানে দুঃখও শ্রেয়, মৃত্যুও বরণীয়। যেখানে বিশ্বের ভালো নিয়ে কথা সেখানে সমস্ত নিয়ম একেবারে শেষ পর্যন্ত মানতেই হবে। সেখানে কোনো বন্ধন কোনো দায়কেই অস্বীকার করতে পারব না । আমাদের পিতা এইখানেই মহদভয়ং বজ্ৰমুদ্যতম। এইখানেই তিনি পুত্রকে এক চুল প্রশ্রয় দেন