পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী (ع ۹ ما দশের ইচ্ছা যদি কেবল বাইরে থেকে তাড়না করে তবে তাকে কাটিয়ে ওঠা যায়, কিন্তু সে যখন আমারই হচ্ছা-আকার ধরে আমারই চূড়ার উপরে বসে হাল চেপে ধরে, আমি যখন জানতেও পারি নে যে বাইরে থেকে সে আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে, তখন তার সঙ্গে লড়াই করবার ইচ্ছামাত্রও চলে যায় । এতবড়ো একটা সম্মিলিত বিরুদ্ধতার প্রতিকূলে আমার একলা মনের ইচ্ছাটিকে জাগিয়ে রাখতে হবে, এই হয়েছে আমার কঠিন সাধনা | q কিন্তু আশার কথা এই যে, নারায়ণকে যদি সারথি করি তবে অক্ষৌহিণী সেনাকে ভয় করতে হবে না। লড়াই একদিনে শেষ হবে না, কিন্তু শেষ হবেই, জিত হবে তার সন্দেহ নেই। এই একলা লড়াইয়ের একটা মস্ত সুবিধা এই যে, এর মধ্যে কোনোমতেই ফাকি ঢোকাবার জো নেই। দশজনের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে কোনাে কৃত্রিমতাকে ঘটিয়ে তােলবার আশঙ্কা নেই। নিতান্ত খাটি হয়ে চলতে হবে । টাকা, বিদ্যা, খ্যাতি প্রভৃতির একটা আকর্ষণ এই যে, সেগুলোকে নিয়ে সকলে মিলে কড়াকড়ি করে । অতএব আমি যদি তার কিছু পাই তবে অন্যের চেয়ে আমার জিত হয়। এইজন্যেই সমস্ত উপার্জনের মধ্যে এত ঈর্ষা ক্ৰোধ লোভ রয়েছে। এইজন্যে লোকে এত ফাকি চালায় । যার অর্থ কম সে প্ৰাণপণে দেখাতে চেষ্টা করে তার অর্থ বেশি, যার বিদ্যা অল্প সে সেটা যথাসাধ্য গোপন করবার চেষ্টায় ফেরে । এই-সকল জিনিসের দ্বারা মানুষ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায়, সুতরাং জিনিসে যদি কম পড়ে তবে ফাকিতে সেটা পূরণ করবার ইচ্ছা হয়। মানুষকে ঠকানোও একেবারে অসাধ্য নয়, এইজন্যে সংসারে অনেক প্রতারণা অনেক আড়ম্বর চলে, এইজন্যে ভিতরে যদি-বা কিছু জমাতে পারি বাইরে তার সাজসরঞ্জাম করি অনেক বেশি । যে-সব সামগ্ৰী দশের কড়াকড়ির সামগ্ৰী সেইগুলির সম্বন্ধে এই ফাকি অলক্ষ্যে নিজের অগোচরেও এসে পড়ে । ঠাট বজায় রাখবার চেষ্টাকে আমরা দোষের মনে করি নে। এমন-কি, বাহিরের সাজের দ্বারা আমরা ভিতরের জিনিসকে পেলুম বলে নিজেকেও ভোলাই। কিন্তু যেখানে আমার আকাঙক্ষা ঈশ্বরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠালাভের আকাঙক্ষা সেখানে যদি ফাকি চালাবার চেষ্টা করি তবে যে একেবারে মূলেই ফাকি হবে । গয়লা দশের দুধে জল মিশিয়ে ব্যাবসা চালাতে পারে, কিন্তু নিজের দুধে জল মিশিয়ে তার মুনাফা কী হবে। অতএব এইখানে একেবারে সম্পূর্ণ সত্য হতে হবে। যিনি সত্যস্বরূপ র্তাকে কেউ কোনোদিন ফাঁকি দিয়ে পার পাবে না । যিনি অন্তর্যামী তার কাছে জাল জালিয়াতি খাটবে না । আমি তার কাছে কতটা খাটি হলুম তা তিনিই জানবেন— মানুষকে যদি জানাবার ইচ্ছা মনের মধ্যে আসে। তবে কোনোদিন জাল-দলিল বানিয়ে তাকে সুদ্ধ মানুষের হাটে বিকিয়ে দিয়ে বসে থাকব । ঐখানে দশকে আসতে দিয়ে না, নিজেকে খুব করে বঁাচাও । তুমি যে তাকে চাও এই আকাঙক্ষাটির দ্বারা তুমি তাকেই লাভ করতে চেষ্টা করো, এর দ্বারা মানুষকে ভোলাবার ইচ্ছা যেন তোমার মনের এক কোণেও না আসে। তোমার এই সাধনায় সবাই যদি তোমাকে পরিত্যাগ করে তাতে তোমার মঙ্গলই হবে, কারণ, ঈশ্বরের আসনে সবাইকে বসাবার প্রলোভন তোমার কেটে যাবে ! ঈশ্বরকে যদি কোনোদিন পাও তবে কখনো তাকে একলা নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারবে না । কিন্তু সে একটি কঠিন সময় | দশের মধ্যে এসে পড়লেই জল মেশাবার লোভ সামলানো শক্ত হয়, মানুষ তখন মানুষকে চঞ্চল করে, তখন খাটি ভগবানকে মিশালটাই বেড়ে উঠতে থাকে, ক্রমে সত্যের বিকারে অমঙ্গলের সৃষ্টি হয়। অতএব পিতাকে যেদিন পিতা বলতে পারব সেদিন পিতাই যেন সে-কথা আমার মুখ থেকে শোনেন, মানুষ যদি শুনতে পায় তো যেন পাশের ঘর থেকেই শোনে । 5) لاوي