পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬৯২ রবীন্দ্র-রচনাবলী ভারতবর্ষে বিক্রমাদিত যখন রাজা, উজ্জয়িনী যখন মহানগরী, কালিদাস যখন কবি, তখন এ দেশে তপোবনের যুগ চলে গেছে ; তখন মানবের মহামেলার মাঝখানে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। তখন চীন হুন শাক পারসিক গ্রীক রোমক সকলে আমাদের চারি দিকে ভিড় করে এসেছে । তখন জনকের মতো রাজা এক দিকে স্বহস্তে লাঙল নিয়ে চাষ করছেন, অন্য দিকে দেশ-দেশান্তর হতে আগত জ্ঞানপিপাসুদের ব্ৰহ্মজ্ঞান শিক্ষা দিচ্ছেন, এ দৃশ্য দেখবার আর কাল ছিল না ; কিন্তু সেদিনকার ঐশ্বৰ্যমদগবিত যুগেও তখনকার শ্রেষ্ঠ কবি তপোবনের কথা কেমন করে বলেছেন তা দেখলেই বোঝা যায় যে, তপোবন যখন আমাদের দৃষ্টির বাহিরে গেছে তখনো কতখানি আমাদের হৃদয় জুড়ে বসেছে। কালিদাস যে বিশেষভাবে ভারতবর্ষের কবি, তা তার তপোবনচিত্র থেকেই সপ্রমাণ হয় | এমন পরিপূর্ণ আনন্দের সঙ্গে তপোবনের ধানকে আর কে মূৰ্তিমান করতে পেরেছে! রঘুবংশ কাব্যের যবনিকা যখনই উদঘাটিত হল তখন প্রথমেই তপোবনের শান্ত সুন্দর পবিত্র দৃশ্যটি আমাদের চোখের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ল । সেই তপোবনের বানান্তর হতে কুশ সমিৎ ফল আহরণ করে তপস্বীরা আসছেন এবং যেন একটি অদৃশ্য অগ্নি তাদের প্রত্যুদগমন করছে। সেখানে হরিণগুলি ঋষিপত্নীদের সন্তানের মতো ; তারা নীবািরধান্যের অংশ পায় এবং নিঃসংকোচে কুটিরের দ্বার রোধ করে পড়ে থাকে । মুনিকন্যারা গাছে জল দিচ্ছেন এবং আলবালা যেমনি জলে ভরে উঠছে আমনি তারা সরে যাচ্ছেন ৷ পাখিরা নিঃশঙ্কমনে আলবালের জল খেতে আসে, এই তাদের অভিপ্রায় । রৌদ্র পড়ে এসেছে, নীবারধান কুটিরের প্রাঙ্গণে রাশীকৃত, এবং সেখানে হরিণরা শুয়ে রোমন্থন করছে । আহুতির সূগন্ধ ধূম বাতাসে প্রবাহিত হয়ে এসে আশ্রমোন্মুখ অতিথিদের সর্বশরীর পবিত্র করে দিচ্ছে। তরুলতা পশুপক্ষী সকলের সঙ্গে মানুষের মিলনের পূর্ণতা, এই হচ্ছে এর ভিতরকার ভাব ! সমস্ত অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের মধ্যে ভোগলালসানিঠুর রাজপ্রাসাদকে ধিক্কার দিয়ে যে একটি তপোবন বিরাজ করছে তারও মূল সুরটি হচ্ছে ঐ, চেতন অচেতন সকলেরই সঙ্গে মানুষের আত্মীয়-সম্বন্ধের পবিত্র মাধুর্য । কাদম্বরীতে তপোবনের বর্ণনায় কবি লিখছেন- সেখানে বাতাসে লতাগুলি মাথা নত করে প্রণাম করছে, গাছগুলি ফুল ছড়িয়ে পূজা করছে, কুটিরের অঙ্গনে শ্যামাক ধান শুকোবার জনো মেলে দেওয়া আছে, সেখানে আমলক লবলী লবঙ্গ কদলী বন্দরী ফল সংগ্রহ করা হয়েছে, বাঁটুদের অধ্যয়নে বনভূমি মুখরিত, বাচাল শুকের অবিরত-শ্রবণের দ্বারা অভ্যস্ত আহুতিমন্ত্র উচ্চারণ করছে, অরণ্যকুকুটেরা বৈশ্বদেব-বলিপিণ্ড আহার করছে, নিকটে জলাশয় থেকে কলহংস।শাবকেরা এসে নীবারবলি খেয়ে যাচ্ছে, হরিণীর জিহব্যাপল্লব দিয়ে মুনিবালকদের লেহন করছে। এর ভিতরকার কথাটা হচ্ছে ঐ ! তরুলতা জীবজন্তুর সঙ্গে মানুষের বিচ্ছেদ দূর করে তপোবন প্রকাশ পাচ্ছে, এই পুরানো কথাই আমাদের দেশে বরাবর চলে এসেছে। । কেবল তপােবনের চিত্রেই যে এই ভাবটি প্রকাশ পেয়েছে তা নয়। মানুষের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির সম্মিলনই আমাদের দেশের সমস্ত প্ৰসিদ্ধ কাব্যের মধ্যে পরিস্ফুট । যে-সকল ঘটনা মানবচরিত্রকে আশ্ৰয় করে ব্যক্ত হতে থাকে। তাই নাকি প্রধানত নাটকের উপাদান, এইজন্যেই অন্য দেশের সাহিত্যে দেখতে পাই বিশ্বপ্রকৃতিকে নাটকে কেবল আভাসে রক্ষা করা হয় মাত্র, তার মধ্যে তাকে বেশি জায়গা দেবার অবকাশ থাকে না । আমাদের দেশের প্রাচীন যে নাটকগুলি আজ পর্যন্ত খ্যাতি রক্ষা করে আসছে তাতে দেখতে পাই প্রকৃতিও নাটকের মধ্যে নিজের অংশ থেকে বঞ্চিত হয় না। মানুষকে বেষ্টন করে এই যে জগৎপ্রকৃতি আছে, এ যে অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে মানুষের সকল চিন্তা সকল কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। মানুষের লোকালয় যদি কেবলই একান্ত মানবময় হয়ে ওঠে, এর ফাকে ফাকে যদি প্রকৃতি কোনোমতে প্রবেশাধিকার না পায়, তা হলে আমাদের চিন্তা ও কর্ম ক্রমশ কলুষিত ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে নিজের অতলস্পর্শ আবৰ্জনার মধ্যে আত্মহত্যা করে মারে। এই যে প্রকৃতি আমাদের মধ্যে নিতানিয়ত কাজ করছে অথচ দেখাচ্ছে যেন সে চুপ করে দাড়িয়ে রয়েছে, যেন