পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন \ტპ\S) আমরাই সব মন্ত কাজের লোক আর সে বেচারা নিতান্ত একটা বাহার মাত্র, এই প্রকৃতিকে আমাদের দেশের কবিরা বেশ করে চিনে নিয়েছেন। এই প্রকৃতি মানুষের সমস্ত সুখদুঃখের মধ্যে যে অনন্তের সুরটি মিলিয়ে রাখছে, সেই সুরটিকে আমাদের দেশের প্রাচীন কবিরা সর্বদাই তীদের কাব্যের মধ্যে বাজিয়ে রেখেছেন । ঋতুসংহার কালিদাসের কঁচা বয়সের লেখা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মধ্যে তরুণ-তরুণীর যে মিলনসংগীত আছে তাতে স্বরগ্রাম লালসার নীচের সপ্তক থেকেই শুরু হয়েছে, শকুন্তলা কুমারসম্ভবের মতো তপস্যার উচ্চতম সপ্তকে গিয়ে পীেছোয় নি । কিন্তু কবি নবযৌবনের এই লালসাকে প্রকৃতির বিচিত্র ও বিরাট সুরের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে মুক্ত আকাশের মাঝখানে তাকে ঝংকৃত করে তুলেছেন । ধারাযন্ত্ৰ-মুখরিত নিদাঘদিনান্তের চন্দ্ৰকিরণ এর মধ্যে আপনার সুরটুকু যোজনা করেছে, বর্ষায় নবজলসেকে ছিন্নতাপ বানান্তে পবনচলিত কদম্বশাখা এর ছন্দে আন্দােলিত, আপাকশালি-রুচিরা শারদলক্ষ্মী তার হংসরবনূপুরধ্বনিকে এর তালে তালে মন্দ্ৰিত করেছেন এবং বসন্তের দক্ষিণবায়ুচঞ্চল কুসুমিত আম্রশাখার কলমৰ্মর এরই তানে তানে বিস্তীৰ্ণ । বিরাট প্রকৃতির মাঝখানে যেখানে যার স্বাভাবিক স্থান সেখানে তাকে স্থাপন করে দেখলে তার অত্যুগ্রতা থাকে না, সেইখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে এনে কেবলমাত্র মানুষের গণ্ডির মধ্যে সংকীর্ণ করে দেখলে তাকে ব্যাধির মতো অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং রক্তবর্ণ দেখতে হয়। শেকসপীিয়রের দুই-একটি খণ্ডকাব্য আছে, নরনারীর আসক্তি তার বর্ণনীয় বিষয় । কিন্তু সেই সকল কাব্যে আসক্তিই একেবারে একান্ত, তার চার দিকে আর কিছুরই স্থান নেই- আকাশ নেই, বাতাস নেই, প্রকৃতির যে গীত-গন্ধবৰ্ণবিচিত্র বিশাল আবরণে বিশ্বের সমস্ত লজা রক্ষা করে আছে তার কোনো সম্পর্ক নেই । এইজন্যে সে-সকল কাব্যে প্রবৃত্তির উন্মত্ততা অত্যন্ত দুঃসহ রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। কুমারসম্ভবে তৃতীয় সর্গে যেখানে মদনের আকস্মিক আবির্ভাবে যৌবনচাঞ্চল্যের উদ্দীপনা বর্ণিত হয়েছে, সেখানে কালিদাস উন্মত্ততাকে একটি সংকীর্ণ সীমার মধ্যেই সর্বময় করে দেখাবার প্রয়াসমাত্র পান নি। আতশ-কাচের ভিতর দিয়ে একটি বিন্দুমাত্রে সূর্যকিরণ সংহত হয়ে পড়লে সেখানে আগুন জ্বলে ওঠে, কিন্তু সেই সূর্যকিরণ যখন আকাশের সর্বত্র স্বভাবত ছড়িয়ে থাকে তখন সে তাপ দেয় বটে কিন্তু দগ্ধ করে না। কালিদাস বসন্তপ্রকৃতির সর্বব্যাপী যৌবনলীলার মাঝখানে হরপার্বতীর মিলন-চাঞ্চল্যকে নিবিষ্ট করে তার সন্ত্রম রক্ষা করেছেন । কালিদাস পুষ্পধনুর জ্যা-নিৰ্ঘোষকে বিশ্বসংগীতের সুরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ও বেসুরো করে বাজান নি । যে পটভূমিকার উপরে তিনি তার ছবিটি এঁকেছেন সেটি তরুলতা পশুপক্ষীকে নিয়ে সমস্ত আকাশে অতি বিচিত্ৰবৰ্ণে বিস্তারিত । 啤 কেবল তৃতীয় সর্গ নয়, সমস্ত কুমারসম্ভব কাব্যটিই একটি বিশ্বব্যাপী পটভূমিকার উপরে অঙ্কিত। এই কাব্যের ভিতরকার কথাটি একটি গভীর এবং চিরন্তন কথা । যে পাপদৈত্য কোথা থেকে প্রবল হয়ে উঠে৷ হঠাৎ স্বৰ্গলোককে ছারখার করে দেয় তাকে পরাভূত করবার মতো বীরত্ব কোন উপায়ে জন্মগ্রহণ করে । এই সমস্যাটি মানুষের চিরকালের সমস্যা। প্রত্যেক লোকের জীবনের সমস্যাও এই বটে, আবার এই সমস্যা সমস্ত জাতির মধ্যে নূতন নূতন মূর্তিতে নিজেকে প্রকাশ করে। কালিদাসের সময়েও একটি সমস্যা ভারতবর্ষে অত্যন্ত উৎকট হয়ে দেখা দিয়েছিল, তা কবির কাব্য পড়লেই স্পষ্ট বােঝা যায়। প্রাচীনকালে হিন্দুসমাজে জীবনযাত্রায় যে একটি সরলতা ও সংযম ছিল তখন সেটি ভেঙে এসেছিল। রাজারা তখন রাজধর্ম বিস্মৃত হয়ে আত্মসুখপরায়ণ ভোগী হয়ে উঠেছিলেন । এ দিকে শকদের আক্রমণে ভারতবর্ষ তখন বারংবার দুৰ্গতি প্ৰাপ্ত হচ্ছিল। তখন বাহিরের দিক থেকে দেখলে ভোগবিলাসের আয়োজনে, কাব্য সংগীত শিল্পকলার আলোচনায়, ভারতবর্ষ সভ্যতার প্রকৃষ্টতা লাভ করেছিল। কালিদাসের কাব্যকলার মধ্যেও তখনকার সেই উপকরণবহুল সম্ভোগের সুর যে বাজে নি তা নয়। বস্তুত তার কাব্যের বহিরাংশ তখনকার