পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VSA তুলেছে। দুঃখের ভিতর দিয়ে মর্ত শেষকালে স্বর্গের প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। মানসলোকের এই যে দ্বিতীয় তপােবন, এখানেও প্রকৃতিকে ত্যাগ করে মানুষ স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেনি। স্বর্গে যাবার সময় যুধিষ্ঠির তীর কুকুরকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের কাব্যে মানুষ যখন স্বর্গে পীেছোয় প্রকৃতিকে সঙ্গে নেয়, বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজে বড়ো হয়ে ওঠে না। মরীচির তপোবনে মানুষ যেমন তপস্বী হেমকূটও তেমনি তপস্বী, সিংহও সেখানে হিংসা ত্যাগ করে, গাছপালাও সেখানে ইচ্ছাপূর্বক প্ৰথীর অভাব পূরণ করে। মানুষ এক নয়, নিখিলকে নিয়ে সে সম্পূর্ণ, অতএব কল্যাণ যখন আবির্ভূত হয় তখন সকলের সঙ্গে যোগেই তার আবির্ভাব । i রামায়ণে রামের বনবাস হল । কেবল রাক্ষসের উপদ্রব ছাড়া সে বনবাসে তাদের আর কোনো দুঃখই ছিল না। তারা বনের পর বন, নদীর পর নদী, পর্বতের পর পর্বত পার হয়ে গেছেন, তারা পর্ণকুটিরে বাস করেছেন, মাটিতে শুয়ে রাত্রিকাটিয়েছেন, কিন্তু তঁরা ক্লেশবোধ করেন নি । এই-সমস্ত নদীগিরি অরণ্যের সঙ্গে তাদের হৃদয়ের মিলন ছিল। এখানে তারা প্রবাসী নন। অন্য দেশের কবি রাম লক্ষ্মণ সীতার মাহাত্ম্যকে উজ্জ্বল করে দেখাবার জন্যেই বনবাসের দুঃখকে খুব কঠোর করেই চিত্রিত করতেন । কিন্তু বাল্মীকি একেবারেই তা করেন নি- তিনি বনের আনন্দকেই বারংবার পুনরুক্তিদ্বারা কীর্তন করে চলেছেন। রাজশ্বৈর্য র্যাদের অন্তঃকরণকে অভিভূত করে আছে, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মিলন কখনোই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক হতে পারে না । সমাজগত সংস্কার ও চিরজন্মের কৃত্ৰিম অভ্যাস পদে পদেই তাদের বাধা না দিয়ে থাকতে পারে না । সেই-সকল বাধার ভিতর থেকে প্রকৃতিকে তারা কেবল প্রতিকূলই দেখতে থাকেন । আমাদের রাজপুত্ৰ ঐশ্বর্যে পালিত, কিন্তু ঐশ্বর্যের আসক্তি তার অন্তকরণকে অভিভূত করে নি। ধর্মের অনুরোধে বনবাস স্বীকার করাই তার প্রথম প্রমাণ। তার চিত্ত স্বাধীন ছিল, শান্ত ছিল, এইজন্যেই তিনি অরণ্যে প্রবাসদুঃখ ভোগ করেন নি ; এইজন্যেই তরুলতা পশুপক্ষী তার হৃদয়কে কেবলই আনন্দ দিয়েছে। এই আনন্দ প্রভৃত্বের আনন্দ নয়, ভোগের আনন্দ নয়, সম্মিলনের আনন্দ । এই আনন্দের ভিত্তিতে তপস্যা, আত্মসংযম | এর মধ্যেই উপনিষদের সেই বাণী ; তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ । কৌশল্যার রাজগৃহবধু সীতা বনে চলেছেন— । একৈকং পাদপং গুল্মং লতং বা পুষ্পশালিনীম অদৃষ্টরূপাং পশ্যন্তী রামিং পপ্রচ্ছ সাবল । রমণীয়ান বহুবিধান পাদপান কুসুমোৎকরান সীতা বচন সংরবৃ আনয়ামাস লক্ষ্মণঃ । বিচিত্ৰবালুকাজলাং হংসসারসনাদিতাম। রোমে জনকরাজস্য সুতা প্ৰেক্ষ্য তদা নদীম। যে-সকল তরুগুল্ম কিংবা পুষ্পশালিনী লতা সীতা পূর্বে কখনাে দেখেননি তাদের কথা তিনি রামকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। লক্ষ্মণ র্তার অনুরোধে তাকে পুষ্পমঞ্জরীতে ভরা বহুবিধ গাছ তুলে এনে দিতে লাগলেন। সেখানে বিচিত্ৰবালুকাজলা হংসসরসমুখরিতা নদী দেখে জানকী মনে আনন্দ বােধ করলেন।